মো. কামরুজ্জামান, বাগেরহাট: উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের অন্যতম নদীবেষ্টিত উপজেলা রামপাল। ৩৩৫ বর্গকিলোমিটারের এই উপজেলায় পশুর, মরা পশুর মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলসহ ৫০টির অধিক নদী-খাল রয়েছে।
এসব নদী ও খালের পানি লবণাক্ত হওয়ায় এই এলাকার বেশিরভাগ ধানিজমি অনাবাদি থাকত। দীর্ঘদিন পরে পেরিখালি ও রাজনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে এ বছর ইরি মৌসুমে কিছু নদী ও খাল আটকে বাঁধ দিয়ে মিষ্টি পানির সংস্কার করে ধান চাষ করেছিলেন কৃষকরা।
কিন্তু চিংড়ি মাছের পোনা ছাড়ার সময় হওয়ায় প্রভাবশালী ঘের মালিকরা খাল কেটে ধানের জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করাচ্ছে। চিংড়ি চাষের জন্য ওঠানো লবণ পানিতে পচে যাচ্ছে কৃষকের কষ্টের ফসল। এর ফলে দুই শতাধিক কৃষকের ৫০ লাখ টাকার ওপরে ক্ষতি হবে। তবে ১৫-২০ দিন পরে প্রবেশ করালে ধানের ক্ষতি হতো না বলে দাবি কৃষকদের।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও সুফল পায়নি হতদরিদ্র কৃষকরা। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের মধ্য থেকে যাওয়া কালেখারবেড় এলাকার ঘরের খালের বাঁধ কেটে মৎস্য ঘেরে পানি ঢুকিয়েছেন জুলু হাজিসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা। লবণ পানিতে কৃষকের ধান পচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
দু-তিন দিনের মধ্যে এসব ধানের গোড়া পচে নষ্ট হয়ে যাবে দাবি কৃষকদের। শুধু কালেখারবেড় নয়, রামপাল উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের সিংগুরবুনিয়া, রনজয়পুর ও আড়ুয়াডঙ্গা এলাকায়ও একইভাবে ধান চাষ করছেন কৃষকরা। এসব এলাকার ঘের ব্যবসায়ীরা এখন খাল কেটে লবণ পানি ঢোকানের পাঁয়তারা করছেন। কৃষকদের কোনো আবেদন কর্নপাত করছেন না তারা।
কালেখারবেড় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত সাধনা হাওলাদার বলেন, গরু বিক্রি করে এবং এনজিও থেকে লোন নিয়ে ৬ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। ১৫-২০ দিন পর ধান ঘরে তুলতে পারতাম। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাঁধটি কেটে দেয়ায় লবণ পানি ঢুকে ধান গাছ সব মরতে শুরু করেছে। অনেক অনুরোধ করেছি, কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি।
একই গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে বিনামূল্যে বীজ ও সার দেয়ায় কৃষকরা আগ্রহ নিয়ে ধান চাষ করেছিল। তখন লবণ পানি ঠেকাতে সকলের সম্মতি নিয়ে কালেখারখালে বাঁধ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ঘেরে লবণ পানি প্রবেশ করাতে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বাঁধটি কেটে দেয়।
বাঁধটি কাটার আগে চেয়ারম্যান, কৃষি অফিসার ও ইউএনওকে বিষয়টি জানিয়েছি। ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য মাত্র ১৫ দিন সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শোনেনি।
রাজনগর ইউনিয়নের সিংগুরবুনিয়া গ্রামের মনিরুল ইসলাম বলেন, সবার অনুমতি ও সম্মতি নিয়ে খাল কেটে আমরা তিন গ্রামের শতাধিক কৃষক প্রায় একশ একর জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী শেখ মোতাহার আলী, মোকছেদ শেখসহ কিছু ঘের ব্যবসায়ী একই এলাকার চামারখালী ও দোয়ানে খালের বাঁধ কেটে লবণ পানি প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে। এই খাল কেটে লবণ পানি ঢোকালে আমাদের ধান সব নষ্ট হয়ে যাবে।
একই এলাকার আলাউদ্দিন নামের আরেক কৃষক বলেন, মাত্র ১৫ দিন পরে লবণ পানি প্রবেশ করালে আমাদের ধানের কোনো ক্ষতি হতো না। যেকোনো মূল্যে লবণ পানির প্রবেশ ঠেকানো প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। পথে বসা লাগবে এলাকার অর্ধশতাধিক কৃষকের।
রাজনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতানা পারভিন বলেন, ধান চাষের জন্য সকল কৃষক একমত হয়ে খাল আটকে ধান চাষ শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কিছু ঘের ব্যবসায়ী পানি ঢুকিয়ে মাছ চাষ করতে চায়। এ কারণে মাছ চাষিরা বাঁধটি কেটে দিয়েছে। মানবিক কারণে চাষিদের ১৫ দিন সময় দেয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিবুল আলম বলেন, কাউকে সরকারি খাল আটকে রাখার অনুমতি দিতে পারি না। তবে ঘের ব্যবসায়ী ও কৃষকদের মাঝে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা সমাধানের জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা সমাধান করবেন।
এছাড়া খাল না আটকে অন্য কোনোভাবে ধান চাষ করা যায় কিনা, সে বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে কাজ করার পরামর্শ দেন উপজেলার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য