-->
গিলে খেয়েছে প্রভাবশালীরা

খুলনার খাল ৮০-৯০ শতাংশ অবৈধ দখলে

খুলনা ব্যুরো
খুলনার খাল ৮০-৯০ শতাংশ অবৈধ দখলে

এক সময়ে খুলনা ছিল পরিচ্ছন্ন নগরী। মহানগরী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো ঘিরে ছিল অসংখ্য নদী-খাল। খালগুলো একদিকে যেমন ছিল শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম, তেমনই পরিবেশ রক্ষায় ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের পর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা এখানে আসার পর থেকে বাসস্থানের প্রয়োজনে নগরীর পরিধি বেড়ে যায়।

 

বসতি বাড়ার সাথে সাথে সব সরকারের আমলে খাসজমি ও খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলে। প্রভাবশালীরা যেভাবে পেরেছে খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে এবং নিজ নামে রেকর্ড করে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়। নগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৫০ খালের মধ্যে ৩টির অস্তিত্ব নেই। আর যা আছে তার ৮০-৯০ শতাংশ অবৈধ দখলে গেছে। এ দখল প্রক্রিয়ার সাথে ৮১ প্রভাবশালী জড়িত।

 

নগর ও পার্শ্ববর্তী ৪৭ খালের মালিক জেলা প্রশাসন। সিটি করপোরেশন এগুলো তদারকি করে মাত্র। জেলা প্রশাসন ও কেসিসির জরিপে অবৈধ দখলে থাকা খালগুলো হচ্ছে ময়ূর নদ, নিরালা খাল, তাবলীগ মসজিদ সংলগ্ন খাল, নিরালা আবাসিক এলাকার পূর্ব পাশের খাল, ছড়িছড়া, মতিয়াখালী, ক্ষুদিয়ার খাল, মিয়াপাড়া পাইপের মোড়, ক্ষেত্রখালী, লবণচরার গোড়ার খাল, লবণচরা ১নং স্লুইচগেট খাল, লবণচরা খান-এ-সবুরের বাগানবাড়ির খাল, বড় বাজার স্টেশন রোড এলাকার ড্রেন, লবণচরা

 

২নং স্লুইচগেট খাল, নর্থ ব্যাংক খাল, মন্দা, হাজী তমিজউদ্দিন খাল, বাস টার্মিনাল আবাসিক এলাকার খাল, বাস টার্মিনালের পশ্চিম পাশের খাল, তালতলা, তালতলা ইউসুফ স্কুলের দক্ষিণ পাশের খাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পশ্চিম পাশের খাল, ছোট বয়রা শ্মশান ঘাট, বাটকেমারী, হাতিয়া, ডুবি, রায়েরমহল মোল্লাপাড়া, রায়েরমহল বাজার খাল, বাস্তুহারা, দেয়ানা মধ্যস্ত চৌধুরীর খাল, দেয়ানা দক্ষিণপাড়ার খাল, তেঁতুলতলা দশ গেট সংলগ্ন খাল,

 

মাথাভাঙ্গা, সুড়িমারী, খোলাবাড়িয়া, কয়লাতলা, আবাইবুনিয়া, হরিণটানা, মজুমদারের খাল, কাদেরের খাল, চকমুথরাবাদ, বিলপাবলা বাঁশতলা, বিলপাবলা লাইলের খাল, লতা পাহাড়পুর ও বিল পাবলার ক্ষুদে নদী সংলগ্ন খাল।

 

লবণচরা খালের এক অংশ ভরাট করে কেসিসির ৩১নং ওয়ার্ড অফিস, রূপসা সাহেবখালী খালের ওপর কেসিসির মার্কেট, পিটিআই মোড়ের খাল বন্ধ করে ২৮নং ওয়ার্ড অফিস, সাবেক মেয়র শেখ তৈয়েবুর রহমানের বাড়ির পেছনে একজন সাবেক ডেপুটি মেয়র প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, বয়রা শ্মশান ঘাটের খালের মুখ বন্ধ করে ইসলামিয়া কলেজ, নগর ভবনের পেছনে খাল বন্ধ করে একজন আইনজীবীর গাড়ির গ্যারেজ নির্মাণ, সোনাডাঙ্গা খালের মুখ বন্ধ করে মহিলা কমপ্লেক্স নির্মাণ ও নবী নগর খাল ভরাট করে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও বাইপাস সড়ক নির্মাণ হয়েছে।

 

খালের মুখ বন্ধ হওয়ায় আষাঢ়- আশ্বিন মাস পর্যন্ত নগরীর একটি বড় অংশে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বর্ষার চার মাস নিন্মাঞ্চলের দুই লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহায়।

 

অবৈধ দখলদার

কেসিসির ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন এবং ওই বছরে জেলা প্রশাসন ও কেসিসির জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী অবৈধ দখলদাররা হচ্ছেন- সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক মো. সিরাজুল ইসলাম, তেঁতুলতলার মো. আলী আহমেদ, নিরালার শেখ আবেদ আলী, সাবেক কাউন্সিলর শেখ আনোয়ারুল কাদির খোকন, বাগমারার মো. খলিলুর রহমান, আব্দুল মান্নান, হাজী বাড়ির মনিরুজ্জামান এলু, এরশাদুজ্জামান ডলার, খোলাবাড়িয়ার মো. শহিদুল ফকির, সাহেব আলী শেখ, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান, তালুকদার আব্দুল জলিল, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা কমপ্লেক্স ও হার্ড টু রিচ প্রকল্প।

 

মেয়রের ভাষ্য : মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক গত বছর ২৬ আগস্ট বাজেট অধিবেশনে উল্লেখ করেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনে ২৬টি খাল অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে। প্রভাবশালীরা পাকিস্তান আমল থেকে এসব খাল দখল করে আসছে। খাল খননে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এবারের বাজেটে জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় অংকের টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

 

জেলা প্রশাসকের ভাষ্য : খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে আমরা বেশ কয়েকটি খাল দখলমুক্ত করেছি। বাকি খালগুলো ভূমিদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

 

বিলপাবলার পাচুরামের খাল নিয়ে তিনি বলেন, শুনেছি বালু দিয়ে খাল ভরাট করে একাধিক প্রপার্টিসের নামে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। আমাদের কাছে একাধিক জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছে, অতি তাড়াতাড়ি আমারা পাচুরামের খালসহ মহানগরী এবং তার আশপাশ এলাকার সব খালই দখলমুক্ত করার ব্যবস্থা করব।

 

কর্মকর্তার ভাষ্য : কেসিসির এস্টেট অফিসার মো. মনিরুজ্জামান তরফদার এ প্রতিবেদককে বলেন, পাঁচটি কমিটি করে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়। তিন মাস ধরে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ২৬ খালের পূর্ব পাশের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন দখলদারদের দখলে থাকায় পলি পড়ে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়েছে। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে পর্যায়ক্রমে উদ্ধারকৃত খাল খনন করা হবে। প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ময়ূর নদ।

 

এলাকাবাসীর ভাষ্য : বাস্তুহারা কলোনির অধিবাসী আহমেদ রেজা এ প্রতিবেদককে জানান, বর্ষার চার মাস নয় হাজার অধিবাসী হাঁটু পানির মধ্যদিয়ে চলাচল করে। নির্বাচনের সময় কাউন্সিলর প্রার্থীরা সবাই এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়, কেউ কথা রাখে না।

 

পাবলার অধিবাসী সুরাত আলী বলেন, ক্ষুদের খালে কচুরিপানা জন্মানোর কারণে পানি নিষ্কাশনে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। নবীনগর খালের পশ্চিম পাশে ভরাট করে বিভিন্ন ব্যক্তি স্থাপনা করেছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

 

 

মন্তব্য

Beta version