-->

মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংগ্রহশালা ‘টাইগার’ লোকমানের ঘর

বাবুল আহমেদ, মানিকগঞ্জ
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংগ্রহশালা ‘টাইগার’ লোকমানের ঘর
নিজ ঘরে লোকমান বানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের ছবির সংগ্রহশালা

মানিকগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রাম। এ গ্রামের কাঁচা আর ভাঙাচোরা রাস্তার পাশে কালীগঙ্গা নদী ঘেঁষে বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেনের বাড়ি। নয় শতক বসতভিটার ওপর ছোট বাড়িটিতে দুটি থাকার ঘর। একটিতে ছেলে, ছেলেবউ ও নাতি থাকেন।

 

অন্যটিতে স্ত্রীসহ থাকেন লোকমান হোসেন। এই শোবার ঘরটিতেই লোকমান বানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের ছবির সংগ্রহশালা। বিয়ের পর মেয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকে।

 

২০০৯ সালে নিজের শোবার ঘর লোকমান হোসেন জেলার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন। শোভা পাচ্ছে যুদ্ধের সময়কার ঐতিহাসিক নানা ছবি। লোকমানের সংগ্রহশালায় তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার ছবি স্থান পেয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবিত নেই।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেখতে জেলার দূর-দূরান্ত এলাকার স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ছুটে যান। স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসে লোকমানের বাড়িতে আগত দর্শনার্থী বেশি থাকে।

 

সরেজমিনে সংগ্রহশালায় গিয়ে দেখা যায়, যুদ্ধকালীন সময় যারা শহীদ হয়েছেন ও যারা পরে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যারা এখনো জীবিত আছেন, সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবিই সংগ্রহশালায় শোভা পাচ্ছে। ঘরের ভেতরের টিনশেডের বেড়ার চারদিকে চোখ বুলালেই শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আর ছবি।

 

লোকমান হোসেন শুধু এই সংগ্রহশালাই করেননি, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উদ্বুদ্ধ করতে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে বেড়াচ্ছেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস আর বীরত্বগাথা কাহিনী শোনাচ্ছেন।

 

১৯৬৫ সালে লোকমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে জওয়ান হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দুই মাসের ছুটিতে বাড়িতে আসেন। ২৮ মার্চ কর্মস্থলে ফেরার কথা থাকলেও তিনি থেকে যান এলাকাতেই। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ২২ জুন তিনিসহ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি সম্মুখযুদ্ধ করেছেন লোকমান হোসেন।

 

জেলার সবচেয়ে বড় গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে দিয়েছেন নেতৃত্ব। জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার গোলাইডাঙ্গা এলাকায় এ যুদ্ধে তার অসীম সাহসিকতায় ৮৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সহযোদ্ধারা তাকে ‘টাইগার’ উপাধি দেন। এ কারণে জেলাবাসীর কাছে তিনি ‘টাইগার’ লোকমান হিসেবেই বেশি পরিচিত।

 

লোকমান হোসেন জানান, পরিচিত সব মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ছবি সংগ্রহ করতে শুরু করেন। অনেকে আগ বাড়িয়ে ছবি দিলেও আবার অনেকে কালক্ষেপণ করেন। বিশেষ করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহ করতে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে। তবুও পিছু ছাড়েননি।

 

দূর-দূরান্তে পায়ে হেঁটে গিয়েও ছবি সংগ্রহ করতে হয়েছে। এতে তার নিজের অর্থ খরচ করতে হয়েছে। পাসপোর্ট সাইজের ছবি এনে নিজের টাকায় সেগুলো ল্যাবে নিয়ে বড় আকারে তৈরি এবং তা লেমিনেটিং করেছেন। তিনি বলেন, এখনো যেসব মুক্তিযোদ্ধার ছবি সংগ্রহ করতে পারিনি, তাদের ছবি সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

 

সংগ্রহশালা প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা চিরকাল বেঁচে থাকবেন না। যখন কোনো মুক্তিযোদ্ধা জীবিত থাকবেন না, তখন নতুন প্রজন্ম এই সংগ্রহশালায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পারবে।সংগ্রহশালাটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়াই লোকমানের স্বপ্ন। তিনি বলেন, নিজ জেলার সব মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের স্থানসহ ইতিহাস সংরক্ষিত থাকবে।

 

নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে এবং তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এ পর্যন্ত তিনি ৩০টির বেশি স্কুল ও কলেজে গিয়েছেন। ‘এসো মুক্তিযুদ্ধকে জানি ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি’ এই প্রতিপাদ্যে তিনি শিক্ষার্থীদের শোনাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

 

মুক্তিযুদ্ধকালীন আঞ্চলিক কমান্ডার তোবারক হোসেন ওরফে লুডুর অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেন লোকমান হোসেন। জেলা সংসদের সাবেক কমান্ডার তোবারক হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে লোকমানের ছিল সাহসী ভূমিকা। এখন শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে ও উদ্বুদ্ধ করতে স্কুল-কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

 

নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবির সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। তার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানবে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version