ঠাকুরগাঁওয়ের গাছে গাছে উঁকি দিচ্ছে আমের মুকুল। রাস্তার ধারে, বাড়ির আঙিনায়, মাঠ-ঘাটে, আনাচে কানাচে গাছের ডালে হলুদ ও সোনালি বর্ণে শোভা পাচ্ছে মুকুল। ফাগুন হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ, মাতোয়ারা চারপাশ। বাগানজুড়ে মৌমাছির গুঞ্জন আর মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণে মুগ্ধ করেছে প্রকৃতি প্রেমীদের। আমের মুকুল পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগানমালিক ও আম চাষিরা।
ভালো ফলনের আশায় লাভের স্বপ্ন দেখছেন তারা। জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, জেলার পাঁচ উপজেলায় মোট ১ হাজার ৮৪৪টি আম বাগান রয়েছে। যার আয়তন প্রায় ৩ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমি। এছাড়াও বসতবাড়িরসহ মোট ৫ হাজার ৮২ হেক্টর জমির আম গাছ।
উপজেলার বিভিন্ন বাগানে আম্রপালি, সূর্যপূরী, বান্দিগড়সহ বিদেশি কিং চাকাপাত, নাম দোকমাই, চিয়াংমাই, আলফান শো, রেডপার্লমারসহ বিভিন্ন জাতের আম গাছ রয়েছে। এসব বাগানের প্রতিটি গাছেই ব্যাপক মুকুল এসেছে। কোনো কোনো গাছে গুটিও আসতে শুরু করেছে। ভালো ফল পেতে গাছের পরিচর্যা ও পোকা দমনে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক স্প্রে করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন আম চাষি ও বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলায় মোট ৪৯ হাজার ১৮৫ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার থেকেও বেশি আম উৎপাদন হতে পারে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম।
আম চাষিরা জানান, আবহাওয়ার কারণে গত বছর আম চাষে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এবার প্রতিটি গাছে ব্যাপক পরিমাণ মুকুল এসেছে। অনুক‚ল আবওহাওয়া থাকলে আর কোনো রোগ বালাই না আসলে এ বছর আমের বাম্পার ফলন হবে। বড় ধরনের ঝড়বৃষ্টি না হলে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আশা তাদের। এছাড়াও সরকারিভাবে আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে আরো বেশি লাভবান হবেন বলেও জানান তারা।
পীরগঞ্জ উপজেলার আম চাষি মো. আহসান হাবিব (ডিপজল) জানান, তার ২০ একর জমিতে আম্রপালি, সূর্যপূরী, বান্দিগড়িসহ বিদেশি কিং চাকাপাত, নাম দোকমাই, চিয়াংমাই, আলফান শো, রেডপালমারসহ বিভিন্ন জাতের ৮ হাজার আম গাছ আছে। এসব গাছের পরিচর্যায় প্রতিদিন প্রায় ৮-১০ শ্রমিক কাজ করেন। এবার প্রতিটি গাছেই মুকুল এসেছে।
মনে হচ্ছে এবার আমের ভালো ফলন হবে। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হাবিব নামে এক বাগান মালিক বলেন, গত বছর তিন দফায় শিলাবৃষ্টি হওয়ায় আমার আম বাগানে প্রায় ৯ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এবার গাছগুলোতে খুব মুকুল এসেছে। প্রতিটি গাছের পরিচর্যা খুব ভালোভাবে নেয়া হচ্ছে।
আশা করছি, তেমন ঝড়বৃষ্টি না হলে ভালো আম হবে। এবং গত বারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। পীরগঞ্জ উপজেলার ভোমরাদহের আমচাষি মাহমুদুল হাসান বলেন, আমি প্রতি বছরই বাগান লিজ নিয়ে আম চাষ করি। এ বছরও ২০টা বাগান লিজ নেয়া আছে। এবার আমার প্রতিটি বাগানে প্রচুর মুকুল এসেছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে গাছে আমের গুটি আসতে শুরু করবে।
তাই গাছে পোকার আক্রমণ যেন না করতে পারে, মুকুল যেন ভালো থাকে সেজন্য বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন রকম ওষুধ স্প্রে করছি। আশা করছি লাভবান হবো। কিন্তু আমাদের এদিকে আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় চাষিরা আম উৎপাদন করেও বেশি লাভবান হতে পারে না। সরকার যদি আমাদের এসব উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানি ও এলাকায় আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করত তাহলে আমরা আরো লাভবান হতে পারতাম।
এতে করে আম চাষে কৃষকরা আরো বেশি আগ্রহী হতেন বলেও জানান এই কৃষক। উপজেলার হাজীপুরের চাষি আবদুল আজিজ বলেন, আগের তুলনায় এই জেলায় ব্যাপকহারে আম চাষ হচ্ছে। সবার বাগান বা গাছের আম প্রায় একই সময় পরিপক্ক হয়। ফলে সকল গাছের আম এক সঙ্গে বাজারে ওঠে বলে দাম পাওয়া যায় না।
তাই যদি সরকার আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে সেগুলো আমরা সংরক্ষণ করে রাখতে পারতাম ও ভালো মূল্যে বিক্রিও করতে পারতাম। তিনি সরকারিভাবে আম রপ্তানি ও সংরক্ষণের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠন গড়ার দাবির জানিয়েছেন।
রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড়ের আমচাষি আব্দুল খলিল বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার গাছে ব্যাপক মুকুল এসেছে। ইতোমধ্যে কিছু গাছে আমের গুটি আসা শুরু করেছে। এখন পরিচর্যা বলতে শুধু বিষ প্রয়োগ ও গাছে সেচ করতে হচ্ছে। তবে এখন একটু বৃষ্টির প্রয়োজন। বৃষ্টি হলেই চিন্তা নাই। আর বৃষ্টি না হলে ওষুধ মেশানো পানি গাছের মুকুলে স্প্রে করতে হবে।
রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের আশাপাশের প্রতিটি আম গাছে ও বাগানে অনেক মুকুল এসেছে। এবার আমও হয়তো ব্যাপক হবে। তবে সরকার এসব আম রপ্তানি করার উদ্যোগ নিতো তাহলে চাষিরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারতো।
এবার যে হারে আমের মুকুল এসেছে সেগুলো ধরে রাখতে পারলে জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে গাছে সেচ, আমের মুকুল ও গুটি ঝড়া রোধে কীটনাশক স্প্রেসহ আমের ফলন সম্প্রসারণে সকল প্রকার পরামর্শ আম চাষিদের দেয়া হচ্ছে।
এছাড়াও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতার মাধ্যমে জেলায় আম সংরক্ষণের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা বিভিন্ন মিটিং ও সেমিনারে ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ঠাকুরগাঁওয়েও একসময় আম সংরক্ষণে আমভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য