-->
শিরোনাম
টাঙ্গাইল-২ আসন

গোপালপুর-ভূঞাপুরে দলীয় কোন্দলে জর্জরিত আ. লীগ

আ:রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল
গোপালপুর-ভূঞাপুরে দলীয় কোন্দলে জর্জরিত আ. লীগ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা

আ:রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল জেলার রাজনীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তনের হাওয়া বিরাজমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদ পুরুষ ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পর জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া বইছে।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইলের প্রতিটি সংসদীয় আসনে এর প্রভাব পড়ছে। টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনও এর বাইরে নয়। ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামীলীগ এ আসনে আন্তদলীয় কোন্দলে জর্জরিত এবং বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকায় ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় উঠান বৈঠক, কর্মীসভা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। পাশাপাশি যে যেভাবে পারছেন ক্লাব, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে আর্থিক অনুদান দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী হওয়ায় আন্তদলীয় কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রত্যেক প্রার্থী দলের মধ্যে নিজস্ব বলয় (লোকবল) তৈরিতে ব্যস্ত থাকায় দলীয় কর্মসূচির চাইতে নেতা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি নিয়ে বিভক্ত কর্মীরা।

 

এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ দলীয় তানভীর হাসান ছোট মনির। বর্তমান সংসদ সদস্য স্থানীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে হাইব্রিডদের কাছে টানছেন এবং প্রায় সব সময় উঠতি বয়সী তরুণদের নিয়ে চলাফেরা করে থাকেন। এ কারণে ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার(এমপির) কাছে যেতে পারেন না- এ অভিযোগে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ভেতরে ভেতরে একাট্টা।

 

বর্তমান সংসদ সদস্যের বাইরে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক তারা তাকেই একযোগে সমর্থন দেবেন। তবে প্রকাশ্যে এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী সব প্রার্থীই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে বিরোধী প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিচ্ছেন। এক প্রার্থী সমাবেশ আহব্বান করলে অপর প্রার্থীও একই স্থানে একই সময় সমাবেশ আহব্বান করছেন। এ নিয়ে গোপালপুর ও ভূঞাপুরে প্রার্থীদের কর্মীদের মধ্যে মাঝেমধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতে দেখা যায়।

 

সম্প্রতি ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদুল হক মাসুদ গোপালপুরে কম্বল বিতরণ করতে গেলে বর্তমান সংসদ সদস্যের কর্মীরা তার গাড়ি বহরে হামলা চালায়। এ নিয়ে দুই পক্ষই সংবাদ সম্মেলন করে একে অপরের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে।

 

গোপালপুর উপজেলার সাত ইউনিয়ন, এক পৌরসভা এবং ভূঞাপূর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন, এক পৌরসভা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-২(গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে কখনও কোনো একক দলের একাধিপত্য দেখা যায়নি।

 

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত গত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে পাঁচবার আওয়ামী লীগ, চারবার বিএনপি, একবার করে জাতীয় পার্টি ও জাসদের (সিরাজ) প্রার্থী জয় লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. হাতেম আলী তালুকদার ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির মো. হাতেম আলী খানকে পরাজিত করেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি প্রার্থী আফাজ উদ্দিন ফকির জয় লাভ করেন।

 

তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন আওয়ামী লীগের মো. হাতেম আলী তালুকদার। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শামছুল হক তালুকদার ছানু আওয়ামী লীগের মো. হাতেম আলী তালুকদারকে পরাজিত করেন। ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত হন জাসদের (সিরাজ) আ. মতিন হিরু। তিনি হারান জাতীয় পার্টির শামছুল হক তালুকদার ছানুকে।

 

এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্র-উত্তর প্রথম (১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ) নির্বাচনে বিএনপির আব্দুস সালাম পিন্টু আওয়ামী লীগের হাতেম আলী তালুকদারকে পরাজিত করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনে বিএনপির আব্দুস সালাম পিন্টু আবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হেরে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আসাদুজ্জামানের কাছে।

 

২০০১ সালে বিএনপি পুনরুদ্ধার করে আসনটি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আসাদুজ্জামানকে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন আব্দুস সালাম পিন্টু। তিনি পান এক লাখ ৫ হাজার ২৭৩ ভোট, আর খন্দকার আসাদুজ্জামান পান এক লাখ ২ হাজার ৯৯৯ ভোট। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাল্লা ঘুরে খন্দকার আসাদুজ্জামানের দিকে।

 

দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন তিনি। আব্দুস সালাম পিন্টু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় কারাগারে থাকায় তার ছোট ভাই সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বিএনপির প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। খন্দকার আসাদুজ্জামান (আওয়ামী লীগ) পান এক লাখ ৪৪ হাজার ৭১০ ভোট, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু (বিএনপি) পান এক লাখ ৩ হাজার ৫০৯ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আসাদুজ্জামান ও জাতীয় পার্টির(মঞ্জু) আব্দুল আজিজের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।

 

তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন খন্দকার আসাদুজ্জামান। এতে খন্দকার আসাদুজ্জামান পান এক লাখ ৪০ হাজার ৭৫৯ ভোট এবং আব্দুল আজিজ পান ৪ হাজার ২৯৬ ভোট। খন্দকার আসাদুজ্জামান বয়সের ভারে ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ন্যুব্জতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি।

 

জার্মান আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও প্রবাস ফেরত ব্যবসায়ী তানভীর হাসান ছোট মনির দলীয় মনোনয়ন পান। বিএনপি প্রার্থী তৎকালিন যুব দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে পরাজিত করে প্রবাসীদের মধ্যে প্রথম তানভীর হাসান ছোট মনির এমপি নির্বাচিত হন।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনে প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু, ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র বীরমুক্তিযোদ্ধা মাসুদুল হক মাসুদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক খন্দকার আশরাফুজ্জামান স্মৃতি, সাবেক এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে সিআইপি খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল।

 

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় এ আসনের বিএনপির ক্ষমতাধর প্রার্থী সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালম পিন্টুর মৃত্যুদন্ডের আদেশ হওয়ায় এ আসনে বিএনপি এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। আসনটি পুনরুদ্ধারে তার ছোট ভাই কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু প্রার্থী হচ্ছেন।

 

এ আসনে জাকের পার্টির প্রার্থী সংগঠনের টাঙ্গাইল পশ্চিমাঞ্চল কমিটির সভাপতি এনামুল হক মঞ্জু। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু এর আগে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। এবার আটঘাট বেধে মাঠে নেমেছেন- দলীয় মনোনয়ন পেলে তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেবেন।

 

তিনি গোপালপুর-ভূঞাপুরকে স্মার্ট উপজেলা হিসেবে গড়ে তুলতে ১২ দফা ফিরিস্তি নিয়ে জনসাধারণের মনযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করছেন। এরমধ্যে এ দুই উপজেলাকে জ্ঞানের নগরী হিসেবে গড়ে তোলা, দুই উপজেলায় দুইটি আইটি পার্ক স্থাপন, প্রতিটি গ্রামে কৃষি ক্লাব স্থাপন, শিশুপার্ক, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন, চরাঞ্চলের মানুষকে আধুনিকতায় নিয়ে আসা, সন্ত্রাস, জঙ্গি ও মাদকমুক্ত উপজেলা গঠন করা ইত্যাদি রয়েছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু জানান, গোপালপুর-ভূঞাপুরের মানুষ একজন শিক্ষিত-সজ্জ্বন ও ক্লিন ইমেজের মানুষকে এমপি হিসেবে দেখতে চায়। গোপালপুর ও ভূঞাপুর উপজেলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে রয়েছে তার নিবিড় সম্পর্ক বলে তিনি মনে করেন।

 

রাজধানীর ঢাকা ক্লাবের সভাপতি খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল মূলত একজন ব্যবসায়ী। বাবার সুনাম ধরে রাখতে তিনি টাঙ্গাইল-২ আসনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। গোপালপুর-ভূঞাপুরের মানুষ নানা প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে বাবার সূত্রেই তার কাছে যান। তিনি সাধ্যমত তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। এলাকার সাথে তিনি সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।

 

ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মাসুদুল হক মাসুদ দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে এলাকায় পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন সাটিয়েছেন। মহান স্বাধীনতার পর ভূঞাপুর উপজেলা থেকে কেউ এমপি নির্বাচিত হয়নি, বড় দলগুলো কাউকে মনোনয়নও দেয়নি। এবার তিনি আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাবেন বলে বিশ্বাস করেন।

 

সে লক্ষে স্থানীয় পর্যায়ে নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড চালাচ্ছেন। সময়-অসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির টাঙ্গাইলের বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলার আসামি এমপি রানাসহ তার ভাইদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আলোচিত নেতায় পরিণত হয়েছেন।

 

এ কারণে তিনি গোপালপুর-ভূঞাপুরের যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি গোপালপুর-ভুঞাপুরের উন্নয়নে সব সময় সচেষ্ট রয়েছেন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version