কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের লাকসাম, সদর দক্ষিণ, লালমাই, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কচ্ছপ, কুইচ্চা, কাঁকড়া ও ব্যাঙসহ বিভিন্ন উভচর ও জলজ প্রাণী ধরে নিচ্ছে সাওতালসহ বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা ওইসব জলজ প্রাণী ভিনদেশে পাচার করছে গোল্ডেন ফিস নামে।
এতে এ অঞ্চলের পরিবেশে মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিলেও জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম তাদের। আবার এসব প্রাণী একত্র করে স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডোগায় বিভিন্ন পরিবহনে জেলার সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে পাচার হচ্ছে দেদারছে।
জেলা দক্ষিণাঞ্চলের একাধিক সুত্র জানায়, জেলার ভারত সীমান্ত পেরিয়ে সাওতালসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে এ অঞ্চলের ভারসাম্য রক্ষাকারী ওইসব জলজ প্রাণী ধরে ভারত, মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভুটান, নেপাল, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে চোরাইপথে পাচার করছে ওই চক্র।
প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মূখে পড়লেও এসব প্রাণী সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। সীমান্ত হাটে ওইসব জলজ প্রানীর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চোরা পথে পাচার অনেকটা জমজমাট হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের ৫টি উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীসহ আশপাশের পুকুর, ডোবা, নালা, খাল-বিলে কুইচ্চা, কচ্ছপ, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী পাওয়া যায়। আবার বন-বাদারে ও পাহাড়ে হেটে চলা হরেক রকমের গুইসাপ ও ব্যাঙ রয়েছে প্রচুর। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এসব প্রাণী বিশেষ ভূমিকা রাখে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশবিদরা।
বছরের সকল মওসুমে এদেশীয় লোকজন ছাড়াও ভারত সীমান্ত পেরিয়ে বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকেরা দলে দলে এসে বিশেষ কায়দায় ওইসব জলজ ও উভয়চর প্রাণী অবাধে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওইসব শিকারির দল প্রতিদিন বাস, ট্রাক, ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে কুমিল্লাসহ ভারতীয় সীমান্ত এলাকার হাটে চোরাপথে নিয়ে যাচ্ছে এসব প্রাণী।
সূত্রগুলো আরো জানায়, জেলার বিভিন্ন সীমান্তহাটে প্রতি কেজি কুইচ্চা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, কচ্ছপ ৪০০-৫০০ টাকা, কাকড়া ৫০০-৬০০ টাকা, গুইসাপ সাড়ে ৪০০-৫০০ টাকা, ব্যাঙ দেড়-দুই হাজার টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়। খুচরা বাজারে দাম আরো বেশি। এসব প্রাণী ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, সিঙ্গাপুর, কুরিয়া, থাইল্যান্ড ও চীনের লোকজনের প্রিয় খাবার হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ওইসব দেশেই বেশি পাচার হচ্ছে।
আবার স্থানীয় বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজনের প্রিয় খাবারের তালিকায় থাকায় তারাও যত্রতত্র ভাবে নিধন করছে ওইসব প্রাণী। স্থানীয় পরিবেশবিদ ও বিশেষ সম্প্রদায়ের একটি সূত্র জানায়, কুমিল্লার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন সড়ক পথে ওইসব প্রাণী পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ অঞ্চলের হরেক রকম ছদ্দ নামে কয়েকটি চোরাকারবারী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার চেষ্টা করছে ভারত সীমান্ত অঞ্চলের ২ শতাধিক পরিবার।
সূত্রটি আরো জানায়, কুইচ্চা এক ধরনের মাছ। অঞ্চলভেদে কুচিয়া, কুচে মাছ, বাইম নামেও পরিচিত এ প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম ‘মনোপটেরাস’। কুইচ্চা প্রকারভেদে ৩০/৪০ সেন্টিমিটার অধিক লম্বা হয়। অগভীর নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ও নরম মাটির নিচে এদের বসবাস। কুইচ্চা রাক্ষুসে স্বভাবের। ছোট ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার।
শামুক, কেঁচোসহ ময়লা-আবর্জনাও খেয়ে থাকে। অনেক হেকিম-কবিরাজ রোগীর পথ্য হিসেবে কুইচ্চা মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে বিশেষ স¤প্রদায়ের কাছে রয়েছে এর বিশেষ চাহিদা। এছাড়া ওইসব জলজ প্রানীগুলো কোনো কোনো দেশে গোল্ডেন ফিস হিসেবে পরিচিত। প্রকার ভেদে প্রতি শত গ্রাম ১০ ডলার হিসেবে জেলার বিভিন্ন সীমান্ত হাটে বিক্রি হচ্ছে। ওইসব পণ্যে বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রতি প্লেট এদেশীয় টাকায় প্রায় ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চোরাপথে এ দেশে আসা ভিনদেশীয় জলজপ্রাণী শিকারিদের একটি সূত্র জানায়, ভারত সীমান্তের অনেক দাদন ব্যবসায়ীরা এসব প্রাণী শিকারে সরঞ্জাম কেনার জন্য প্রতিনিয়ত বাৎসরিক মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে থাকে।
শিকারিরা বাঁশের তৈরি চাঁই, জাল, বড়শিসহ বিশেষ কায়দায় তৈরি ফাঁদ কিংবা খালি হাতেও অনেকে বিশেষ কৌশলে এসব জলজ ও উভয়চর প্রাণী ধরছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী জলজ, উভয়চর ও বন-বাদাড়ে হেটে চলা প্রাণীগুলো অহরহ চোরা শিকারিদের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত বিনাশ হচ্ছে।
ভিনদেশীয় সূূত্রটির দলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজনগর থানার ঘোষখামার গ্রাম থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী একদল শিকারি। কুমিল্লা জেলার ভারত সীমান্ত পেরিয়ে আসা শাওতাল যুবক রাজু, শ্যামল, প্রধান, সরকার, কৃষ্ণনীল, শংকর, নিত্যনারায়ন, দিপু, মনচঙ্গা, শিশির লাল, গাঙ্গুলিসহ বেশ কয়েকজন শিকারি জানায়, সকল মওসুমে এসব প্রাণী ধরা গেলেও শীতকালে তারা গর্তে ডুকে থাকে তখন ধরা খুব কঠিন।
বর্ষা মওসুমে তেমন ধরা না দিলেও আমাদের নিজ নিজ কৌশলে বের করে আনতে পারি। তারপরও চলমান বর্ষাকালে জীবন-জীবিকার তাগিদে ওইসব প্রাণী ধরতে হচ্ছে। প্রত্যেক সপ্তাহে ৩/৪ দিন চোরাপথে এ অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে ওইসব প্রাণী ধরে সীমান্ত হাটবাজার গুলোতে পাইকারি আড়তে বিক্রি করে থাকি।
জেলা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে ওইসব সম্প্রদায়ের লোকজনের সাবলম্বী করার লক্ষ্যে স্ব-স্ব উপজেলা মৎস্য দপ্তর নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে প্রায় দেড় শতাধিক লোক এ পেশার সঙ্গে জড়িত। লাকসাম উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, লাকসামে ৪৫ জন ওই সম্প্রদায়ের লোকজনকে নানামুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি জলজ ও বনজপ্রাণী সংরক্ষণে আমরা কাজ করছি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য