দিনাজপুরের ৫৬৩ বছরের একটি প্রাচীন নিদর্শন চেহেলগাজী মসজিদ। ধারণা করা হয়, সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর রাজত্বকালে (১৪৬০-১৪৭৪ সাল) বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় নির্মিত এটিই প্রথম মসজিদ। এটির পূর্বপাশে রয়েছে চেহেলগাজী মাজার। তবে প্রাচীন এই মসজিদটির নাম পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাতে নেই। স্থানীয় সচেতন মহল এটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় স্থান দেয়ার দাবি জানিয়েছে।
দিনাজপুর সদর উপজেলার চেহেলগাজী গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তরে। মসজিদের কালনির্দেশক তিনটি শিলালিপি ছিল। এর একটি দিনাজপুর জাদুঘরে ও দুটি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
এ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ৮৬৫ হিজরির ১৬ সফর (১৪৬০ সালের ১ ডিসেম্বর) মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর রাজত্বকালে তার উজির ইকরার খানের নির্দেশে তৎকালীন পূর্ণিয়া জেলার অন্তর্গত জোর ও বারুর পরগনার শাসনকর্তা উলুঘ নুসরত খান বৃহত্তর দিনাজপুরে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
বর্তমানে মসজিদটির দেয়াল ছাড়া আর কোনো অংশ অবশিষ্ট নেই। দেয়ালগুলোও ভগ্নপ্রায়। দেয়ালে কোনো অলঙ্করণ দেখা যায় না। তবে মেহরাবের কাছে কিছু পোড়ামাটির ফলক এখনো বর্তমান। এগুলোর বেশিরভাগই খুলে পড়ছে।
বর্গাকার মসজিদটির মূল কক্ষের ওপর একটি এবং পূর্বদিকের বারান্দার ওপর সম্ভবত তিনটি গম্বুজ ছিল। মসজিদের স্থাপত্য পরিকল্পনার এ রীতি মোগল যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
বাইরের দিকে মসজিদের মূলকক্ষের আয়তন ৪ দশমিক ৯০ মিটার। মূলকক্ষের পূর্বদিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দুটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ আছে। পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথের মধ্যে মাঝের খিলানের উচ্চতা ২ দশমিক ৬০ মিটার এবং প্রস্থ শূন্য দশমিক ৭৭ মিটার।
পূর্বদিকের বারান্দার দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৯০ মিটার এবং প্রস্থ ১ দশমিক ৮৩ মিটার। বারান্দায় প্রবেশের জন্য মূলকক্ষের পূর্বদিকের অনুরূপ আয়তনবিশিষ্ট তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে পশ্চিমদিকে রয়েছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মেহরাবটি পাশের দুটির তুলনায় একটু বড়। মেহরাবগুলো বহুপত্র খিলানবিশিষ্ট। মেহরাবের অলঙ্করণে পাথর দেখা যায়। পাথর ও পোড়ামাটির ফলক দিয়ে এ মেহরাবগুলো সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত। পোড়ামাটির ফলকগুলোর মধ্যে ফুল, লতাপাতা ও ঝুলন্ত মোটিফ লক্ষণীয়।
এদিকে, মাজারটিতে সময় নির্দেশক কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ওয়েস্টমেকট ১৮৭৪ সালে চেহেলগাজী মসজিদ থেকে তিনটি শিলালিপি উদ্ধার করেন। এ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৪৬০ সালে চেহেলগাজী মসজিদটি নির্মাণ করার সময় মাজারটি সংস্কার করা হয়। অর্থাৎ মসজিদের আগেই মাজারটির অস্তিত্ব ছিল। শিলালিপিতে চেহেলগাজী বা অন্য কোনো নামের উল্লেখ নেই। বুকানন হ্যামিল্টনের প্রতিবেদন থেকে প্রথম চেহেলগাজী মাজার সম্পর্কে জানা যায়।
স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, ৪০ জন গাজীকে একত্রে এখানে সমাহিত করা হয়। এজন্য এ স্থানের নাম হয় চেহেল (চেহেল ফার্সি শব্দ, বাংলায় এ শব্দের অর্থ চল্লিশ), গাজী (ধর্মযোদ্ধা)। গোপাল নামে এক স্থানীয় হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওই গাজীদের ৩৭ জন শহীদ হয়েছিলেন। পরে বাকি তিনজনে যুদ্ধ করে জয় লাভ করেন। পরবর্তীকালে তারা মৃত্যুবরণ করলে তাদেরও এখানে সমাহিত করা হয়।
সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের কামরূপ অধিকারের সময় (১৩৫৮ সাল) সম্ভবত এ যুদ্ধটি হয়েছিল। এরকম কান্তনগরে (গড় মল্লিকপুর) এবং খানসামায় আরো দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং নিহত সৈনিকদের যৌথভাবে সমাহিত করা হয়। প্রায় ১০০ বছর পরে ১৪৬০ সালে মাজারটি মেরামত করা হয়। আগে মাজারের ওপরে কোনো আচ্ছাদন বা ছাদ ছিল না। ১৯৬৮ সালে এ মাজারের ওপরে ছাদ নির্মাণ করা হয়। চারপাশে দেয়াল তৈরি করে মাজারটিকে আবৃত করা হয় মূল্যবান রেশমি কাপড়ে এবং নির্মিত হয় তোরণ। নবনির্মিত ঘরটির আয়তন ২৫ দশমিক ১৫ মিটার। মাজার সংলগ্ন পূর্বদিকে একটি, দক্ষিণ দিকে তিনটি বাঁধানো প্রাচীন কবর রয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চেহেলগাজী মসজিদ, মসজিদের দক্ষিণে আরো একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোণে ১৭০ মিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি প্রাচীন পুকুর রয়েছে। পূর্বদিকে এর চেয়ে ছোট আরেকটি প্রাচীন পুকুর অবস্থিত। মাজারের পশ্চিম দিকে শালবন।
মসজিদ ও মাজারের খাদেম মো. মোমিনুল ইসলাম জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষক নকশা দেখে মসজিদটি সুলতানি আমলের নিদর্শন বলে জানিয়েছেন। এছাড়া মসজিদে নির্মাণকাল নির্দেশক তিনটি শিলালিপি ছিল। এর একটি দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এই শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৪৬০ সালে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। সে হিসেবে এ স্থাপনার বয়স ৫৬৩ বছর।
চেহেলগাজী মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মো. আফজালুল হক বলেন, ইরাকের বাগদাদ থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচারে আসা ৪০ জন গাজীর সঙ্গে গোপাল রাজার যুদ্ধ চলাকালে ৩৭ জন শহীদ হন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেন তিনজন এবং জয়লাভ করেন। পরবর্তীকালে তারা মৃত্যুবরণ করলে তাদেরও এখানে সমাহিত করা হয়। তাদের কবর ঘিরেই এই মাজার। ওই তিন গাজী মধ্যে একজনের নাম জানা গেছে । তিনি জয়নুদ্দিন বাগদাদি।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য