-->

বগুড়ায় দুই যুগে ৫১ জাতের মসলার সফল উদ্ভাবন

এনামুল হক রাঙ্গা, বগুড়া
বগুড়ায় দুই যুগে ৫১ জাতের মসলার সফল উদ্ভাবন
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় মসলা গবেষণা কেন্দ্র

দেশে এবং প্রবাসে বাঙালির খাবারে মসলা ছাড়া ভাবাই যায় না। এই উপাদানের পেছনে দেশে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণও বেশি। তবে সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে দেশেই এখন মসলা উৎপাদন হচ্ছে।

 

এ কাজে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মসলা গবেষণা কেন্দ্র। গত দুই যুগে এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১৫৬টি মসলা ফসলের প্রযুক্তি ও ৫১টি জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এতে করে আমদানি নির্ভরতা কমছে দেশে।

 

১৯৯৬ সালে বগুড়া থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে মহাস্থানগড়ের অদূরে শিবগঞ্জের রায়নগর এলাকায় ৭০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই মসলা গবেষণা কেন্দ্র। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীনে এ গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত হয়।

 

কেন্দ্রটি মসলার বহুমুখী জাত উদ্ভাবন করে সবার নজরে এসেছে। এ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের অধীনে ৩টি আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র ও ৪টি উপআঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। আঞ্চলিক মসলা কেন্দ্র মাগুরা, কুমিল্লা ও গাজীপুরে। উপআঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র লালমনিরহাট, ফরিদপুর, সিলেট ও খাগড়াছড়িতে।

 

শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য মতে, এ গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত উচ্চ ফলনশীল (উফশী) নানা জাতের মসলা উদ্ভাবন করেছে। এ পর্যন্ত ৪৬টি মসলা ফসল নিয়ে গবেষণা করে ১৫৬টি মসলা ফসলের প্রযুক্তি ও ৫১টি জাত উদ্ভাবন করেছে এ গবেষণা কেন্দ্র।

 

এর মধ্যে পেঁয়াজের ৭টি, পাতা পেঁয়াজের ১টি, মরিচের ৪টি, অর্নামেন্টাল মরিচের ২টি, রসুনের ৪টি, আদার ৩টি, হলুদের ৫টি, ধনিয়ার ২টি, বিলাতি ধনিয়ার ১টি, কালোজিরার ১টি, মেথীর ৩টি, ফিরিঙ্গী ১টি, মৌরির ২টি, শলুক ১টি, রাঁধুনী ১টি, জাউন ১টি, একাঙ্গীর ১টি, চিভের ১টি, পুদিনার ২টি, আলুবোখারার ১টি, দারুচিনি ১টি, তেজপাতা ১টি, গোলমরিচের ১টি, পানের ৩টি এবং জিরার ১টি জাত। যা বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে।

 

চলতি মসলার সঙ্গে গবেষণাধীন অন্যান্য অপ্রচলিত মসলা ফসলগুলো হলো : শলুক, তেজপাতা, রাঁধুনী, জোয়ান, ফিরিঙ্গি, চুঁইঝাল, একাঙ্গি, পিপুল, শঠি, দই রং, বচ, পুদিনা, পোলাও পাতা, লেমনগ্রাস, আম আদা, মিঠা তুলশি, পান, সুপারি, জিরা, কাবাবচিনি, চিভস, অলস্পাইস, কারিপাতা, পান বিলাস, লবঙ্গ, পেস্তা বাদাম, জয়ফল, জৈয়ত্রী, ভ্যানিলা, রোজমেরী, বিলাতি ধনিয়া ইত্যাদি।

 

মসলা গবেষকরা বলছেন, দেশে মসলার মোট চাহিদা ৫৮ দশমিক ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে আমদানি হয় ৪৪ দশমিক ৯৬ লাখ টন। এরপরও ঘাটতি থেকে যায় আরও ১৩ দশমিক ৫৪ লাখ টন। ২০১৯-২০ সালে দেশে শুধু মসলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। কৃষকদের মসলা চাষে স্বাবলম্বী করতে পারলে আমদানিবাবদ প্রচুর টাকা সাশ্রয়ী করা সম্ভব।

 

শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার ড. মো. মাসুদ আলম বলেন, এ গবেষণা কেন্দ্রের অধীনে উদ্ভাবিত আদা-রসুনের গুঁড়া, পেঁয়াজের গুঁড়া, কাঁচামরিচের গুঁড়া ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে মসলার ঘাটতি কিছুটা কমে যাবে ও দেশের আমদানিনির্ভরতা হ্রাস পাবে। উদ্ভাবিত সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তিগুলো মসলা গবেষণার কেন্দ্রের বড় ধরনের সাফল্য।

 

মসলা গবেষণা কেন্দ্রে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আছে। এখানকার গবেষকরা বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের মাঝে এসব প্রযুক্তিগত চাষব্যবস্থার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

 

এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হলো, ঢিবি পদ্ধতিতে আদা রোপণের উন্নত প্রযুক্তি, জিংক ও বোরন প্রয়োগে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ ধারণ, ফলন এবং গুণগত মান বৃদ্ধি, গ্রীষ্মকালীন মরিচ ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আন্তঃফসল চাষ, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আদার কন্দ পচা রোগ নিয়ন্ত্রণ, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আদার কন্দ পচা রোগ দমন, সমন্বিত পুষ্টি ও সেচ ব্যবস্থাপনায় রসুনের ফলন বৃদ্ধি,

 

বিনা চাষে মালচ ব্যবহার করে মানসম্পন্ন রসুন উৎপাদন, চুন এবং বোরন প্রয়োগে রসুনের ফলন এবং সংরক্ষণ যোগ্যতা বৃদ্ধি, চারার মাধ্যমে হলুদ উৎপাদন, হলুদ ও মরিচের আন্তঃফসল চাষ, রোগের সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা, স্টোরে পেঁয়াজের রোগজীবাণু ও বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজের কন্দের পচন ও গজানোর হার নির্ণয়।

 

শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কে, এম, খালেকুজ্জামান জানান, ‘দেশের একেক এলাকার মাটি একেক ধরনের মসলা উৎপাদনের জন্য উপযোগী, শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্র যে যে মসলা উদ্ভাবন করছে তা মাঠ পর্যায়ের কৃষকের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে, এ মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে জিরা, ইসবগুল ও উচ্চ মূল্যের ভ্যানিলাসহ মসলা ফসলের আরো নতুন জাত উদ্ভাবনের উপর গবেষণা কাজ চলছে।

 

এ ছাড়াও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজকে কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানো এবং রাইজম পচা প্রতিরোধী আদার জাত উদ্ভাবনে এ কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে।

 

শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার হায়দার প্রধান বলেন, মসলা প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৫ হাজার ৬০০ জন বিজ্ঞানী, কৃষি কর্মকর্তা, বিএডিসি কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

 

এ গবেষণা কেন্দ্রে বিশাল পরিসরে গবেষণা কাজ পরিচালনার জন্য কর্মরত বিজ্ঞানীর সংখ্যা অপ্রতুল। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ফেলোশিপ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সিরিয়াল ফুড ও ভেজিটেবল চাষের আধিক্যের কারণে মসলা চাষের জমির স্বল্পতা রয়েছে। এ কেন্দ্রে বিদেশি মসলা জার্মাপ্লাজম সংগ্রহের সুযোগও কম। আবহাওয়াগত সমস্যা ও প্রশিক্ষিত জনবলের এখনো অভাব রয়েছে।

 

এ ছাড়াও কীটপতঙ্গ, রোগ, খরা ও লবণাক্ত জেনোটাইপের অভাব রয়েছে। এ কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত সব জাত ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করে থাকে। মসলার ঘাটতি কাক্সিক্ষতভাবে কমিয়ে আনতে এ কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version