-->
শিরোনাম
বিপজ্জনক বিষফোঁড়া রোহিঙ্গা

কক্সবাজার এখন বদলে যাওয়া জনপদ

এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার
কক্সবাজার এখন বদলে যাওয়া জনপদ
কক্সবাজার জেলার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন সাড়ে ১৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এটা দাপ্তরিক হিসাব। স্থানীয়রা বলছেন, প্রকৃত হিসাবে সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি হবে। বিপুলসংখ্যক আশ্রিত রোহিঙ্গার কারণে কক্সবাজার এখন বদলে যাওয়া এক জনপদ।

 

যত দিন যাচ্ছে, স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় রোহিঙ্গার সংখ্যা ততই বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয়রাই একসময় কক্সবাজারে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। কারণ রোহিঙ্গাদের জন্মহার স্থানীয়দের তলনায় ৪/৫ গুণ বেশি। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারাই এখন বিপজ্জনক বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও ঝুলে আছে স্রেফ আলোচনাতেই।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে, ৯টি উপজেলা মিলিয়ে কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ২৩ হাজার ২৬৫ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৪০ জন, চকরিয়া উপজেলায় ৫ লাখ ৭১ হাজার ২৭৭ জন, পেকুয়া উপজেলায় ২ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৭ জন, কুতুবদিয়ায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬২২ জন, মহেশখালীতে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫০৭ জন,  রামুতে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৫ জন, উখিয়ায় ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৬ জন, টেকনাফে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৩ জন এবং ঈদগাঁও উপজেলার জনসংখ্যা ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৬। এদিকে স্রেফ উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতেই সাড়ে ১৪ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করছে।

 

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৯০ থেকে ১০০টি শিশু। বিপুল এই জনস্রোতের পরিষেবা জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। ক্রমাগত অপরাধকান্ডের জড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

 

বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে নিজেদের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, আশ্রয় পাওয়ার পাঁচ বছর পর এখন বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা এমন আচরণ করছে, যেন তারাই এখানকার প্রকৃত অধিবাসী।

 

কারণ উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্রোতের মতো আসা রোহিঙ্গাদের চাপে কৃষিজমি, শ্রমবাজার ও শিক্ষাসহ ওই অঞ্চলের মানুষজনের জীবনের নানা দিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্থানীয় মানুষজন ও উন্নয়নকর্মীরা জানাচ্ছেন। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশও ধ্বংস হচ্ছে।

 

সার্বিকভাবে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের কাঁধে বোঝা হয়ে বসা রোহিঙ্গাদের সন্তান জন্মদান বেড়েই চলছে। নানা রকম প্রচারের পরও জন্মনিয়ন্ত্রণে তাদের উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না। গেল পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২ লাখের বেশি শিশু জন্মলাভ করেছে।

 

ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত নিবন্ধিত শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ৭৮ হাজার। বর্তমানে ক্যাম্পে বসবাসকারীদের মধ্যে ৫২ শতাংশেরও বেশি রোহিঙ্গার বয়স আঠারোর নিচে। গড়ে শতাধিক শিশু জন্মানোর পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতে একাধিক বিয়ে ও বাল্যবিয়ের প্রবণতা কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে। অধিক সন্তান জন্মদানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হলেও এসবের প্রভাব পড়ছে না তাদের মনোজগতে।

 

সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ১২ হাজার একর বনভ‚মি ধ্বংস হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এজন্য দুই হাজার ২৩১ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য।

 

এ ছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা আশ্রিত ক্যাম্পগুলোর সঙ্গেই রয়েছে স্থানীয়দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতি ও চাষযোগ্য জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ কারণে অনেকের ভিটেবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও চাষাবাদের জমি অঘোষিতভাবে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয় দরিদ্র লোকজন।

 

একইভাবে শ্রমবাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ৩২টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এসব গ্রুপের অপতৎপরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোতে সশস্ত্র জঙ্গি রয়েছে পাঁচ সহস্রাধিক। আর তাদের নিরস্ত্র সমর্থক রয়েছে ২ লক্ষাধিক।

 

২০১৮ সালে মে মাসে দেশব্যাপী শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২৭৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৯ জন, যার মধ্যে তিনজন নারীও ছিলেন। শুধু নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি নয়, রোহিঙ্গাদের হামলায় এ পর্যন্ত ১১ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। পাশাপাশি অপহরণকান্ডও ঘটছে প্রায়ই। শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি কত দিন নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, এ নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয়রা।

 

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে যত দেরি হবে, ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ততই খারাপ হবে বলে মনে করছে সচেতন মহল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শরণার্থী শিবিরে সংঘাত, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন যেন স্বাভাবিক চিত্র।

 

রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতি ছিল। কিন্তু ক্যাম্পগুলোয় প্রতিবছর ৪৫ হাজারের বেশি নবজাতক যোগ হচ্ছে। সেই হিসাবে পাঁচ বছর পাঁচ মাসে ক্যাম্পে যোগ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ।

 

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। ২০২২ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ৯ লাখ। কিন্তু এটিও যথার্থ হিসাব নয়। প্রকৃত অর্থে সংখ্যাটি ১৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। কারণ গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা, তারা এ হিসাবে আসেনি। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা।

 

কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে দেখা গেছে, রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম, মাহিন্দ্র গাড়ির চালক, খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে, জেলেদের ফিশিং বোটে, বিভিন্ন প্রকার যানবাহনে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য কাজ এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ টেকনাফের স্থলবন্দরের অভ্যন্তরেও রোহিঙ্গারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। শুধু উখিয়া বা টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহরেও রোহিঙ্গা শ্রমিকদের উপস্থিতি ৬৫ শতাংশ।

 

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। তবে ২২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাড়ে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এ কারণে জনভোগান্তি এখন অন্তহীন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version