কুমিল্লা দক্ষিণাঞ্চলে সহস্রাধিক মৎস্য প্রকল্প গিলে খাচ্ছে কয়েক হাজার হেক্টর আবাদি কৃষিজমি এবং কয়েক হাজার কোটি টাকার কাঁচা-পাকা সড়ক। লাকসাম, বরুড়া, নাঙ্গলকোট, লালমাই ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে জেলা-উপজেলা কৃষি ও মৎস্য বিভাগের দায়িত্বহীনতা ও নীরব ভূমিকার কারণে এ ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ। মৎস্য প্রকল্প করার ক্ষেত্রে গ্রামীণ সড়কগুলোর পাশে আলাদা বেড়ি (প্রটেকশন বাঁধ) করার নিয়ম থাকলেও তা কেউ মানছে না।
ওইসব মৎস্য প্রকল্পের মালিকরা সরকারি রাস্তা বেড়ি হিসেবে ব্যবহার করলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে সরকার ইতিমধ্যে মৎস্য চাষিদের স্থানীয় মৎস্য বিভাগ থেকে নিবন্ধন বিধিমালা জারি করলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা ও আন্তরিকতার অভাবে সরকারি ওই আদেশটি লাল ফিতায় বন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের সরকারি ফিসারির ব্যবস্থাপনা এবং সরকারি পুকুর-জলাশয় লিজ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
জেলার দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল মৎস্য চাষের ফলে সার্বিক ক্ষেত্রে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি রাস্তা মৎস্য প্রকল্পের বেড়ি হিসেবে ব্যবহার ও কালভার্টের মুখ বন্ধ করে পানি নিষ্কাশন পথে প্রতিবন্ধকতা করে গড়ে উঠেছে এখানকার মৎস্য প্রকল্পগুলো। বর্ষা মৌসুমের পানি চলে গেলেও কৃত্রিমভাবে প্রকল্পের ভেতরে পানি আটকে রাখা হয়। ফলে সড়কের একপাশে পানি এবং অন্য পাশে না থাকায় একদিকের পানি চুইয়ে সড়কগুলো আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে প্রথমে ফাটলের সৃষ্টি হয়।
ফাটলগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে ধসে পড়তে থাকে প্রকল্পের দিকে। লাকসাম, বরুড়া ও নাঙ্গলকোট পৌরশহর এবং উপজেলাগুলোর ইউনিয়নের বেশিরভাগ কাঁচা-পাকা ও ইটের গ্রামীণ সড়কগুলো হুমকির মুখে আছে এবং একাধিক সড়কসহ অন্তত শতাধিক কাঁচা-পাকা সড়ক এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব সড়কে যান চলাচল এখন ঝুঁঁকিপূর্ণ।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার অভাবে গত কয়েক বছর যাবত এ অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকাতেই আবাদি কৃষি জমিতে মৎস্য চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত কৃষি জমি কমছে। এলাকার নিম্নাঞ্চল বর্ষাকালের শুরুতেই প্রায় সময় জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত থাকে। এ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক সংযোগ খাল জবর দখল এবং কোথাও কোথাও ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নামার সব পথই বন্ধ হয়ে গেছে।
অপরদিকে লাকসাম পৌর এলাকাসহ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমি নিয়ে প্রায় ৪ হাজার ৪৭০টি পুকুর, মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ৯টি, মৎস্য বহুমুখী সমবায় সমিতি ৯৩টি, মৎস্যজীবী সমিতি ৮টি, মৎস্যচাষি সমিতি ৮টিসহ ৩১৭টি নামে-বেনামে সমিতি মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। চলমান অর্থবছরের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উপজেলা মৎস্য বিভাগ অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
এ ছাড়া সরকারি পুকুর ৫৬টি, খাল ১৮টি, মৎস্য হ্যাচারি ১৬টি, মৎস্য নার্সারি পুকুরের সংখ্যা ৯৪, চিংড়ি চাষির সংখ্যা ১০ জন, বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা মৎস্য খামারের সংখ্যা ৩০৮টি, জেলে সংখ্যা ৮৬৭ জন ও মৎস্যচাষি ১ হাজার ৬৫০ জন। অপরদিকে পৌর এলাকাসহ ৮টি ইউনিয়নের ১৬৮ গ্রামে রয়েছে ১৯টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল। আবাদি কৃষিজমির পরিমাণ ১০ হাজার ৩৩২ হেক্টর জমি, মোট ফসলি জমি রয়েছে ২২ হাজার ৬০ হেক্টর জমি।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ১৬৭টি গ্রামে ফসলি জমি প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমি, মৎস্য চাষি ৮২২ জন, মৎস্যজীবী ১ হাজার ৭৫০ জন, পোনা ব্যবসায়ী ৫৫ জন, মৎস্য খামার ছোট-বড় ১১৩টি, পুকুর প্রায় ২ হাজার ৩শটি, বেড়ি প্রায় দেড় শতাধিক, মৎস্য হ্যাচারি ২টি, মৎস্য নার্সারি ২৪টি। তবে বেসরকারি হিসাবে প্রায় এর দ্বিগুন বেশি।
উপজেলাগুলোর একাধিক পরিবেশবাদী নেতা মুঠোফোনে বলেন, সরকারি কাঁচা-পাকা রাস্তা মৎস্য প্রকল্পের বেড়ি হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে একসময় যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন এলাকার সাধারণ মানুষকে আরো ভোগান্তির শিকার হতে হবে।
স্থানীয় সরকার দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মৎস্য প্রকল্প মালিকরা সড়ককে বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে মাছ চাষের ফলে সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। সড়ক থেকে ছয় ফুট দূরত্বে পৃথক বেড়ি নির্মাণ করে মাছ চাষের নিয়ম থাকলেও প্রকল্প মালিকরা তা মানছেন না। কয়েক দিন আগে মনেহরগঞ্জের শাহাপুর-খরখরিয়া সংযোগ সড়কটি নির্মানে ৫-৬ মাসের মাথায় গাছপালাসহ ধসে পড়ে।
জেলা-উপজেলা মৎস্য দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, মৎস্য প্রকল্পের চাষিরা তাদের ব্যক্তিগত জমিতে মাছ চাষ করেন তাই মৌখিক সতর্ক ছাড়া অনেক সময় আমাদের কিছু করার থাকে না।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য