-->
শিরোনাম

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য তাঁতশিল্প শাড়ির স্থানে থ্রিপিস-পাঞ্জাবির আধিক্য

আ. রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল
টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য তাঁতশিল্প শাড়ির স্থানে থ্রিপিস-পাঞ্জাবির আধিক্য
সেমি অটো বা কাঠ পাওয়ারলুমে কাপড় বুনছেন এক নারী। ছবিটি কালিহাতী উপজেলার রামপুর গ্রাম থেকে তোলা

পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের তৈরি শাড়ি, থ্রিপিস ও পাঞ্জাবির বাজার জমে উঠেছে। এক সময়ের আভিজাত্য ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ এখন অনেকটা উৎসবনির্ভর হয়ে পড়েছে। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে থ্রিপিস, সালোয়ার-কামিজ ও পাঞ্জাবি। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য তাঁতশিল্প প্রধান এলাকাগুলোতে এখন শাড়ি তৈরির পাশাপাশি থ্রিপিস ও পাঞ্জাবির কাপড়ও তৈরি করা হচ্ছে।

 

জেলার বিভিন্ন এলাকায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও কালিহাতী উপজেলার বল্লা, কোকডহড়া, নাগবাড়ী, পাইকরা ইউনিয়ন এবং দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডী, পাথরাইল ও সদর উপজেলার পৌলী, চরপৌলীসহ আশপাশের এলাকা তাঁতশিল্প প্রধান হিসেবে পরিচিত। টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প দেশের অন্যতম ও প্রাচীন কুটিরশিল্প। এ অঞ্চলের উৎপাদিত তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের স্বর্ণযুগ ছিল। ওই সময় ‘দি সেন্ট্র্রাল কো-অপারেটিভ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড (সিসিএএল)’ নামে সমিতির মাধ্যমে তাঁতিদের মাঝে সুতা বণ্টন করা হতো। ওই সময় পিটলুম ও হ্যান্ডলুম বা খটখটি ও চিত্তরঞ্জন তাঁতে কাপড় তৈরি হতো। এক পিস ভালো মানের শাড়ি উৎপাদন করতে ৩-৪ দিন এবং এক পিস লুঙ্গি তৈরিতে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগত।

 

বাজারে চাহিদা ও দামও ছিল আশানুরূপ। কিন্তু ১৯৭৫ সালের কালো অধ্যায়ের পর তাঁতিদের জীবনেও অমানিষা নেমে আসে। সিসিএএল নামীয় প্রতিষ্ঠান প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছার কদর বাড়তে থাকে। দেশ-বিদেশে টাঙ্গাইল শাড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

 

কিন্তু তাঁত বোর্ডের সুবিধা না পাওয়ায় ১৯৯০ সালের পর দফায় দফায় রং, সুতাসহ কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা ও অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে তাঁতিরা আবার মুখথুবড়ে পড়ে। এরপর থেকে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পে ধস নামতে থাকে। তাঁত ফ্যাক্টরিগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় তাঁতশিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।

 

১৯৯২ সালের হিসাব অনুযায়ী, টাঙ্গাইল জেলায় এক লাখের অধিক তাঁত এবং এক লাখ ৫০ হাজার তাঁতি পরিবার ছিল। ২০১৩ সালের শুমারিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইল জেলায় ৬০ হাজার তাঁত ছিল। এরমধ্যে ৮ হাজার ৩০৫টি পিটলুম, ৫১ হাজার ১৪১টি চিত্তরঞ্জন এবং ৮৯২টি পাওয়ারলুম। সেই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের তাঁতের সংখ্যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ২৯৪টি।

 

টাঙ্গাইল জেলার তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটাতে জেলার কালিহাতী ও সদর উপজেলায় বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের (বাতাঁবো) দুটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, নাগরপুর, মির্জাপুর, বাসাইল ও সখীপুর উপজেলার জন্য সদর উপজেলার বাজিতপুরে অবস্থিত বেসিক সেন্টার থেকে ৩০৫ জন তাঁত মালিকের মাঝে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা সরল সুদে ঋণ দেয়া হয়েছে।

 

কালিহাতী, ঘাটাইল, ভূঞাপুর, গোপালপুর, মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার জন্য কালিহাতী উপজেলপার বল্লায় অবস্থিত বেসিক সেন্টার থেকে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা ক্ষুদ্র ঋণ এবং তাঁতশিল্পের আধুনিকায়নে চলতি মূলধন হিসেবে ৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কালিহাতী বেসিক সেন্টার থেকে দেয়া ঋণ রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদার তাঁতিদের মাঝে বণ্টনের অভিযোগ রয়েছে।

 

সূত্র মতে, বাতাঁবোর টাঙ্গাইল সদর কার্যালয়ের আওতায় ১৪ হাজার ৬৪৪টি তাঁতের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার পিটলুম এবং ৯ হাজার ১৪৪টি চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ারলুম। কালিহাতী বেসিক সেন্টারের আওতায় ২১ হাজার ৬৫০টি তাঁতের মধ্যে কোনো পিটলুম নেই। সবই চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ারলুম। অথচ পাওয়ারলুমের মালিকদের তাঁতের আধুনিকায়ন ও চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ দেয়ার এখতিয়ার বেসিক সেন্টারের নেই।

 

তাঁত মালিকরা জানান, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের লকডাউনে তাঁতের শাড়ি তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে অসংখ্য কারিগর বেকার হয়ে পড়েন। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যান। এরপর ২০২০ সালের বন্যায় জেলার তাঁতশিল্প আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার পানিতে কারখানার তাঁত, তাঁতে থাকা সুতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদি নষ্ট হওয়ায় বিনিয়োগের লোকসান হয়। এরপরও তাঁতশিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল।

 

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের রমজানের আগ মুহূর্তে তাঁত ফ্যাক্টরিগুলো খুলে দেয়া হয়। এরই মধ্যে সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যসহ কাঁচামালের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে সেখানেও আরেকবার ধাক্কা দেয়। প্রথমে তাঁতিরা অস্থায়ী সংকট মনে করলেও ক্রমশ তাঁতশিল্প স্থায়ী সংকটে নিপতিত হয়। বর্তমানে প্রায় ৮৫ শতাংশ হস্তচালিত তাঁত বা পিটলুম ও চিত্তরঞ্জন বন্ধ রয়েছে। তাঁত মালিকরা দাবি করেন, বাতাঁবোর বেসিক সেন্টারের তাঁতের পরিসংখ্যান সঠিক নয়। তারা শুধু সমিতির সদস্যদের তাঁতের হিসাব রাখেন।

 

একটি তাঁতের পেছনে পরিবারের ছোট সদস্যটিও শ্রম দিয়ে থাকে। কেউ শাড়ি বুনেন, কেউ চড়কায় সুতা কাটেন, কেউ কাপড়ের নকশার সুতা (ঝর্ণা) কাটেন। আবার সুতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেয়ার কাজ করে থাকে।

 

তাঁতিরা জানান, আজকাল বাঙালি নারীদের ৮৫ শতাংশ সালোয়ার-কামিজ বা ম্যাক্সি কাপড় পড়ে থাকেন। ১৫ শতাংশ নারী শাড়ি পরলেও তা ৬০/১, ৬১/১, ৬২/১, ৭০/১ ইত্যাদি কাউন্টের সুতায় তৈরি। এসব কাউন্টের সুতায় উৎপাদিত শাড়ির দাম অনেক কম।

 

তারা জানান, টাঙ্গাইলের হস্তচালিত তাঁত বিলুপ্তির পথে। অধিকাংশ কারিগর খটখটি ও চিত্তরঞ্জন ছেড়ে সেমিঅটো বা হ্যান্ড পাওয়ারলুম ও অটো বা পাওয়ারলুমে চলে গেছে। খটখটি (পিটলুম) ও চিত্তরঞ্জন তাঁতে শাড়ি বুনতে সময় বেশি লাগে। শাড়ি বুনে যা উপার্জন হয় এতে সংসার চলে না।

 

কিন্তু পাওয়ারলুম বা সেমি অটো পাওয়ারলুমে অল্প সময়ে বেশি শাড়ি বুনানো যায়। শুধু তাই নয়, একজন দক্ষ কারিগর একসঙ্গে পাশাপাশি চারটি পাওয়ারলুমে কাজ করতে পারেন। ফলে কারিগররা পাওয়ারলুম ও সেমি অটো বা হ্যান্ড পাওয়ারলুমের দিকে ঝুঁকছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version