-->
শিরোনাম
কাজে আসছে না সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ

খুলনায় তীব্র গরমে সুপেয় পানির সংকট

খুলনা ব্যুরো
খুলনায় তীব্র গরমে সুপেয় পানির সংকট
খুলনার কয়রায় সুপেয় পানির জন্য লাইনে দাড়িয়ে আছে নারী-পুরুষরা

কাঠফাটা রোদ ও প্রচন্ড গরমের তীব্রতায় সুপেয় পানি সংকটে ভুগছে খুলনাঞ্চলের মানুষ। বছরের অন্তত ৬ মাস পানি সংকটে থাকলেও সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহনের পরেও স্থায়ী সমাধান পাচ্ছে না এ অঞ্চলের মানুষ। গত ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে খুলনার পিকচার প্যালেস মোড়ে ওয়াটার এক্সপ্রেস বাংলাদেশ, জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরাম ও হিউম্যানিটি ওয়াচ সংস্থার ব্যানারে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

 

সমাবেশে বক্তারা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় পানির সংকট নিরসনে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানান। এ অঞ্চলের পানি সমস্যা সমাধানে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুনোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

 

সরেজমিনে খুলনা নগরী ও তার আশপাশের উপজেলাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর ডাকবাংলা মোড়, তারের পুকুর মোড়, ফুলমার্কেট মোড়, সাহেবের কবরখানা, বাইতিপাড়া মোড়, বড়মির্জাপুর অনির্বাণ মোড়, মৌলভী পাড়া মোড়, রূপসা বাজার এলাকা, নতুন বাজার এলাকা, বাগমারা, চানমারী বাজার, ময়লাপোতা, ডালমিল মোড়, বয়রা বাজার মোড়, সোনাডাঙ্গা বাইপাস, মোল্লাবাড়ীর মোড়, হরিণটানা থানা মোড়, গল্লামারী, জিরোপয়েন্ট, মোহাম্মদ নগর সহ নগরীর আশপাশের এলাকায় ওয়াসার পানির লাইন এবং মিষ্টি পানির নলকূপগুলোতে পানি সংগ্রহের দীর্ঘ লাইন লক্ষ করা গেছে।

 

ওয়াসার অনেক লাইনে পানি না থাকায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরেও অনেকেই খালি কলস নিয়ে ফিরে গেছে বাড়িতে। আবার যারা সুপেয় খাবার পানি পেয়েছে তাদের অনেককেই অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এছাড়া পানির কষ্টে থাকা বিভাগের অন্যান্য জেলা-উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ভালো ভাবে পানযোগ্য পানি পেয়ে থাকে।

 

বাকি ৬ মাস তাদের পানির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। খুলনার রূপসা, তেরখাদা, বটিয়াঘাটা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা উপজেলা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলা এবং বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা ও মোড়েলগঞ্জ, যশোর, কেশবপুর, মণিরাপুর,নোয়াপাড়া, নড়াইল সদর, কালিয়া উপজেলার মানুষ বেশি পানির কষ্টে ভোগে। এসব এলাকায় খাবারযোগ্য মিষ্টি পানির নির্ধারিত অল্প সংখ্যক সরকারি-মালিকানাধিন মিষ্টি পানির পুকুর এবং গভীর-অগভীর মিষ্টি পানির নলকূপ।

 

একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলের অধিকাংশ পুকুরের পানি কমে গেছে। আবার অধিকাংশ নলকূপে মিষ্টি পানি না ওঠার কারণে পানি কষ্ট এ অঞ্চলের মানুষের জন্য চরম আকার ধারণ করছে। এসব এলাকায় পানি সমস্যা সমাধানে স্বল্প মেয়াদী উদ্যোগ আরও দুর্ভোগ বাড়িয়েছে মানুষের। স্থাপন করা হয়েছে পিএসএফ ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মতো প্লান্ট। স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণে দায়ভার তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কারণে এগুলো নষ্ট হয়েছে দ্রুত।

 

পরে সেগুলো আর মেরামত বা সংরক্ষণ করা হয় না। সরকারি এসব উদ্যোগের কারণে স্থানীয় মানুষ পানি সংরক্ষণে নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহারেও আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে কষ্ট লাঘব হচ্ছে না। এছাড়া এনজিওগুলো পৌর এলাকায় ওভারহেড ট্যাংকের মাধ্যমে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ, রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট, বায়ো স্যান্ড ফিল্টার বসানোর পর সেগুলোও নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতিনির্ভর টেকসই প্রকল্প গ্রহণ না করায় এর সুফল পাচ্ছে না মানুষ।

 

খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, জেলার ৬৭ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি ব্যবহার করতে পারে। বাকি ৩৩ শতাংশ মানুষকে নিজস্ব পদ্ধতিতে পানির জোগান দিতে হয়। তবে সরকারি এ হিসেবের সাথে একমত নন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা।

 

সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকমল হোসেন জানিয়েছেন, জেলায় ১ হাজার ৮৪৮টি নলকূপ চালু রয়েছে। যেগুলো দিয়ে সুপেয় পানি উত্তোলন করা হয়। এছাড়া ২ হাজারের মত রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ও পিএসএফ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একই সাথে জেলার সুপেয় পানি সমস্যা সমাধানে দাকোপে আরও ফিল্টার স্থাপন, দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল অধিদপ্তর এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে কমিউনিটি ভিত্তিক ১৫ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট স্থাপন করা হচ্ছে।

 

এগুলো বাস্তবায়ন হলে ওই এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং স্থানীয় মানুষের অসচেনতায় পিএসএফ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগারগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ায় একটি পিএসএফ স্থাপন করে দুস্থ্য স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে)। স্থানীয়রাই এটির দেখাশোনা করতো। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে পুকুরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে সেটি বন্ধ রয়েছে। মানুষের পানির জন্য এখন মজা পুকুরের পানিই পান করতে হচ্ছে।

 

২০১১ সালে কয়রার বাগালী ইউনিয়নের বাঁশখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি পিএসএফ বসায় জেজেএস। ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট একই স্কুলে দুই হাজার লিটার ধারণক্ষমতার রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করে একই বেসরকারি সংস্থা। বর্তমানে এই দুটি পদ্ধতি থেকে আর পানি পাচ্ছে না মানুষ। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করায় দুটোই নষ্ট হয়েছে। এই গ্রামের বাসিন্দা রাসেল মিয়া বলেন, আমাদের বাড়ি থেকে বাঁশখালী স্কুল প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে। প্রথম দিকে আমরা ভালো পানি পেতাম। তবে এখন ওই সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এখন এলাকার পুকুরের পানি খাই।

 

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের এলাকায় চারিদিকে (নদীর পানি) পানি। তবে খাবার পানি আনতে হয় ৮ কিলোমিটার দূরের একটি নলকুপ থেকে। সরকার যে উদ্যোগই নেয় প্রতিবছরের ঝড়ে তা নষ্ট হয়ে যায়। লবণ পানির ব্যবহারের কারণে এলাকার নারী ও শিশুদের মধ্যে রোগ বাড়ছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় কেউ কাউকে সাহায্য পর্যন্ত করতে পারে না।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version