-->
শিরোনাম

সুঁই-সুতায় সচ্ছল কাউনিয়ার নারীরা

বাবলুর রহমান বারী, রংপুর
সুঁই-সুতায় সচ্ছল কাউনিয়ার নারীরা
রংপুরের কাউনিয়ায় সুঁই ও সুতায় টুপি তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা

সুনিপুণ হাতের স্পর্শে তৈরি হচ্ছে কারুকাজ খচিত টুপি। সুঁই ও সুতা থেকে সরছে না কারো দৃষ্টি। কেউ ব্যস্ত টুপির ওপর নকশা বুনতে কেউবা আবার কাপড় কাটতে। রাত-দিন চলছে এমন কর্মযজ্ঞ। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই কারো। দিনের পর দিন এভাবেই একেকটি টুপি রূপ নিচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শিল্পে।

 

রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নের সাব্দী ও ভ‚তছাড়া গ্রামে দেখতে পাওয়া যায় এমন দৃশ্য। এই ইউনিয়নসহ কাউনিয়া উপজেলার কমবেশি প্রতিটি গ্রামে আছেন এমন টুপি তৈরির কারিগর।

 

করোনা মহামারির কারণে গত তিন বছর থমকে ছিল টুপি রপ্তানি। খুব বেশি চাহিদা না থাকায় তেমন ব্যস্ততাও ছিল না কারিগরদের। তবে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসাতে আবার বেড়েছে টুপির চাহিদা। রপ্তানিমুখী টুপি ঘিরে তিস্তা নদীবেষ্টিত কাউনিয়া উপজেলার অন্তত ৩০ গ্রামের ২৫ হাজারের বেশি নারী এখন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

 

এর মধ্যে স্বামী-পরিত্যক্তা ও হতদরিদ্র প্রায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার নারীর মূল পেশাই এখন টুপির কাজ। সংসারের কাজ সামলে অবসরে টুপিতে নকশা বোনেন নারীরা। এতে বাড়তি আয়ের মুখ দেখছেন তারা। এ কাজ করে পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। বাজারে পাকিস্তানি টুপি শীর্ষস্থান দখল করে থাকলেও রংপুর অঞ্চলের দৃষ্টিনন্দন টুপি দেশের গন্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ ওমান, কুয়েত, কাতার, সৌদি ও বাহরাইনসহ প্রায় ২০টি দেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে।

 

সরেজমিনে কাউনিয়ার শহীদবাগ ইউনিয়নের সাব্দি ভ‚তয়াড়া গ্রামে দেখা গেছে, সাংসারিক কাজ কিংবা রান্নাঘরেও চলছে টুপি তৈরির কাজ। এই টুপি তৈরি করে একসময়ের অভাব-অনটনে থাকা দরিদ্র নারীদের জীবনচিত্রই পাল্টে গেছে। তারা এখন স্বাবলম্বী।

 

তাদের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। অভাব শব্দটি তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেও আগের মতো নেই হতাশার ছাপ। রংপুরে এই শিল্পের শুরুর গল্পটা এমন ছিল না। কাউনিয়ার সাব্দী গ্রামে ১৯৯৮ সালে টুপির কাজ নিয়ে আসেন জহির উদ্দিন। ভোলা থেকে আসা এ আগন্তুককে তখন গ্রামের অনেকেই জায়গা দিতে রাজি হয়নি।

 

বাড়ির একটি ঘর ছেড়ে দিয়ে টুপি তৈরির শুরুটা দেখতে চেয়েছিলেন ওই বাড়ির বাসিন্দা আবোর উদ্দিন। এখন তিনি বেঁচে নেই। আবোর উদ্দিনের সেই বাসা থেকেই শুরু নারীদের হাতের সেলাই করা টুপির কাজ। শুরুর দিকে কয়েকজন নারী জড়িত থাকলেও ক্রমাগত তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তারপর মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু করেন। আরব দেশে এই টুপির চাহিদা বেশি থাকায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জহিরকে। বর্তমানে ওমানে তার দুটি টুপির দোকান রয়েছে।

 

কাউনিয়ার হড্ডাপাড়া গ্রামের টুপির কারিগর নুরনাহার, মাজেদা, হাওয়া বেগম, শেফালী বেগম জানান, একটি টুপির নকশা বুননসহ অন্য কাজ মিলে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন। মাসে গড়ে তারা একেকজন ৩-৪টি করে টুপি তৈরি করেন। প্রতিটি টুপিতে নির্দিষ্ট নকশা ও সাইজ অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। কঠিন অভাব ডিঙিয়ে আসা একই উপজেলার সাব্দী গ্রামের আংগুরা বেগম বলেন, ‘স্বামীর টাকা দিয়্যা হামার সংসার ঠিকমতো চলে নাই।

 

সোগসময় একটা না একটা সমস্যা নাগি আছিল। এ্যলা আল্লাহর রহমতে হামরা ভালো আছি। আগের মতো স্বামী-সন্তান নিয়্যা কষ্ট নাই। সংসারের কামের পাশাপাশি এ্যলা টুপি সেলাইয়ের কামো করোং। কোনো মাসে ৩ হাজার, ফির কোনো মাসে ২ হাজার টাকা আয় হয়।’

 

সেখানকার খোর্দ্দ ভুতছড়া গ্রামের টুপি শ্রমিক আমেনা ও আনিছা বেগম জানান প্রায় ১২ বছর ধরে টুপি তৈরির কাজ করছেন। তাদের একেকজনের এখন মাসিক আয় পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা। তারা টুপির চারদিকে মোটা সুতা ঢোকানোর কাজ করেন, যাকে বলা হয় হাসু।

 

এতে প্রতিটা টুপির জন্য ৫০ থেকে ৮০ টাকা করে পেয়ে থাকেন। রপ্তানিযোগ্য এ শিল্পের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে বালাপাড়া ইউনিয়নের টুপি ব্যবসায়ী তাউস ট্রেডিং অ্যান্ড গার্মেন্টসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বেকার ও দুস্থ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই টুপি শিল্প সচ্ছলতার পথ খুলে দিয়েছে।

 

তিনি আরো বলেন, কর্মী ও এজেন্টদের মাধ্যমে আমরা টুপি তৈরি করে নিচ্ছি। কর্মীদের বাড়ি বাড়ি সুতাসহ টুপি দিয়ে আসি নকশা করার জন্য। প্রতি পিস টুপিতে নকশা করার জন্য তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টুপি ওমানে পাঠানো হচ্ছে।

 

মান, আকার ও প্রকারভেদে একেকটি টুপি তৈরিতে খরচ পড়ছে ৭০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব টুপি ৬ হাজার টাকা থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। টুপি তৈরির কাজ করে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version