-->
শিরোনাম

দক্ষিণাঞ্চলে ফের দস্যু আতঙ্ক

বরিশাল ব্যুরো
দক্ষিণাঞ্চলে ফের দস্যু আতঙ্ক
দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরার ট্রলার

ইলিশ ধরার মৌসুমকে সামনে রেখে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলে পল্লীর বাসিন্দারা সাগরে কাঙ্খিত মাছ শিকারের পর ধারদেনা পরিশোধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। এরইমধ্যে অতি সম্প্রতি কক্সবাজারের নাজিরারটেক সমুদ্র উপকূলে টেনে আনা ডুবন্ত ট্রলার থেকে ১০ জেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর থেকেই সাগরে মাছ ধরা বরিশালের উপকূলীয় এলাকার জেলেদের মধ্যে দীর্ঘদিন পর জলদস্যু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

 

গত কয়েক বছর ধরে সাগরে দস্যুতা কমে আসলেও ফের শুরু হয়েছে দস্যুদের তান্ডব। এতে যেমন নতুন করে জেলেসহ মৎস্যজীবীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, তেমনি মৎস্য সেক্টর ধসের আশঙ্কা করছেন অনেকে। কক্সবাজারে মাছ ধরা ট্রলারে অর্ধগলিত ১০ জেলের মরদেহ উদ্ধারের পর বরিশাল বিভাগের বরগুনার উপকূলীয় এলাকা পাথরঘাটা থেকে সাগরে যেতে গড়িমসি করছেন প্রায় দশ হাজার জেলে। একে তো অথৈ সাগরে জেলেদের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, তার মধ্যে নতুন করে দস্যুদের তান্ডবের অজানা আতঙ্কে এখন সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছেন জেলেরা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে পাথরঘাটা থেকে ৮০ কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরে পায়রা বন্দর থেকে পশ্চিমে বয়া এলাকায় মাছ ধরার একটি ট্রলারে জলদস্যুদের হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ট্রলারের ১৮জন জেলের ওপর গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে নয়জন জেলেকে গুরুতর জখম করে দস্যুরা।

 

এ সময় জীবন বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপিয়ে পরে নিখোঁজ হয় আরও নয়জন জেলে। কয়েকদিন পর নিখোঁজ নয় জেলের মধ্যে চারজনের মরদেহ সাগর থেকে উদ্ধার করেছে অন্য জেলেরা। আহত অপর একজন জেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। ওই ঘটনায় এখনো পাঁচজন জেলের কোনো সন্ধান মেলেনি।

 

সূত্রমতে, সাগরে দস্যুতার ঘটনায় জেলেসহ মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তার জন্য র‌্যাবের স্থায়ী ক্যাম্পের দাবি বার বার উঠে আসছে। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় কয়েক বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে দস্যুমুক্ত থাকলেও অতি সম্প্রতি আবার দস্যুদের হামলার ঘটনায় জেলেদের মধ্যে ফের অজানা আতঙ্ক শুরু হয়েছে। যে কারণে আবারও দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকার মৎস্যজীবীদের মধ্যে র‌্যাবের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের দাবি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

 

জেলে আব্দুল্লাহ মিয়া, সগীর হোসেন ও জাকির হোসেন বলেন, এমনিতেই আমরা সাগরে ঝড়-জলোচ্ছাস সহ নানা দুর্যোগ মোকাবেলা করে মাছ ধরি। একটা সময় ছিলো সাগরে দস্যুদের বিচরণের কারণে তাদের (দস্যু) কাছ থেকে পাস কার্ড নিয়ে সাগরে যেতে হয়েছে।

 

২০১৮ সালে সরকার সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত ঘোষণার পর গত কয়েক বছর ধরে সাগরে একেবারেই দস্যু শুন্য ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি আবারও সাগরে জলদস্যুদের উৎপাত শুরু হয়েছে।

 

ওইসব জেলেরা আরও বলেন, এভাবে দস্যুদের আক্রমণ চলতে থাকলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়। তাই দস্যু দমনে র‌্যাবের স্থায়ী ক্যাম্পের দাবি করছি।

 

মৎস্যজীবীরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে জেলেরা নির্বিঘেগ্ন সাগরে মাছ ধরে আসছিলেন। এখন আবারও দস্যুতা শুরু হওয়ায় জেলেদের মধ্যে নতুন করে অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন থেকে পাথরঘাটায় র‌্যাবের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের দাবি করা হলেও এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।

 

মৎস্যজীবীদের দাবি, সাগরে দস্যু নির্মূলে উপকূলে র‌্যাবের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের বিকল্প নেই। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, সাগরে অস্থিরতা তৈরি করলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবেনা।

 

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার জেলেদের সাথে মতবিনিময়ের সময় পাথরঘাটায় র‌্যাবের স্থায়ী ক্যাম্পের দাবি করায় আশ্বস্ত করেছিলেন র‌্যাবের জিডি আব্দুল্লাহ আল মামুন। ওইসময় তিনি (র‌্যাবের জিডি) বলেছিলেন, দস্যুতা করলে কাউকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবেনা। আমরা সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করেছি। সমুদ্রও আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। র‌্যাব সদস্যরা সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

 

উপকূলের জেলেদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, উপকূলের মানুষের অর্থনৈতিক চাকার মূল উৎস গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণ। জলদস্যু আতঙ্কে সেই সাগর ছেড়ে জেলেরা এখন ডাঙায় দিনযাপন করছেন।

 

তিনি বলেন, মো. হেলাল নামের এক জেলে গত বছর নভেম্বর মাসের শেষেরদিকে বরগুনার পাথরঘাটা থেকে মাছ শিকার করতে গভীর সমুদ্রে গিয়ে জলদস্যুদের অপহরনের শিকার হন। একইসময় আরও সাতজন জেলে অপহৃত হন। মেরে ফেলা হয় একজন জেলেকে।

 

সূত্রমতে, সম্প্রতি বরগুনার পাথরঘাটা, কুয়াকাটাসহ বেশ কিছু উপকূলীয় এলাকা থেকে ১০০ থেকে ৬০ কিলোমিটার গভীর সমুদ্রে জলদস্যু প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে র‌্যাব। অপহরণের শিকার জেলেদের কাছ থেকে দস্যুরা আদায় করে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপন। তাই জলদস্যু আতঙ্কে উপকূলের বহু জেলে এখন সমুদ্রে মাছ ধরা ছেড়ে দিয়েছেন।

 

জেলেদের দাবি, দেশের পাশাপাশি সমুদ্রে অন্যদেশের জলদস্যুরাও অপহরণ করে তাদের নির্যাতন করছে। দস্যু আতঙ্কের প্রভাবে দেশের অন্যতম সামুদ্রিক মাছের পাইকারি বাজার পাথারঘাটায় আগের মতো কাঙ্খিত মাছের আমদানি নেই।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version