-->
শিরোনাম

হাজারো পরিবারের খুঁটি জিতু রায়

বাবলুর রহমান বারী, রংপুর
হাজারো পরিবারের খুঁটি জিতু রায়
জিতু রায়ের প্রতিষ্ঠানে কাপড়ে নকশা তোলার কাজ করছেন একদল নারী

মানুষের শৈশব জীবনে অনেক কষ্ট হয়ে ওঠে তার জীবনের ইতিহাস। ঠিক তেমনি ‘জিতু’ অপর নাম জিতু রায়। ১৯৮৮ সালের রংপুর নগরীর ঠিকাদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মহেন্দ্র রায় ও মঞ্জু রানী ঘরে জন্ম নেয় জিতু রায়। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে সবার বড় জিতু হতদরিদ্র পরিবারের এক আশার আলো হয়ে জন্মেছিল, তখন হয়তো পরিবারের কেউ বুঝতে পারেনি।

 

জন্মের চার বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে পায়ের চলার শক্তি হারান জিতু, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। দিনমজুর বাবার দৈনিক আয় ৩০ টাকায় চালিত সংসারে যেখানে খাবার জোটে না সেখানে তার চিকিৎসা আকাশ কুসুম কল্পনার মতো অবস্থা। দারিদ্র্য, হতাশা, দুরারোগ্য ব্যাধি সবকিছু পেছনে ফেলে অদম্য শক্তি নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। স্বপ্ন তিনি পড়াশোনা করে মানুষ হবেন। এই ইচ্ছা দেখে বাবা তাকে স্কুলে কাঁধে করে নিয়ে যেতেন এবং আসতেন। কিন্তু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে অর্থসংকটের অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তার।

 

বাধ্য হয়ে ২০০৫ সাল থেকে জিতু খোঁজেন উপার্জনের পথ, শুরু করেন ভাঙ্গাড়ির ব্যবসা। কিন্তু কিছুদিন ব্যবসা করলেও সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার অচল পা। বাবার কাঁধে করে শিখতে চান মোবাইল ফোন সার্ভিসিংয়ের কাজ, কিন্তু রংপুর সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় বাবার কাধে করে ওঠানামার কষ্টের কারণে সেখানেও টিকতে পারেনি জিতু। হঠাৎ করে মাথায় আসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ। কিন্তু কোথায় পাবেন কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগের টাকা।

 

এই বেহাল অবস্থা দেখে ২০০৯ সালে তার নিকটতম বন্ধু তৌফিক তাকে নিজের কম্পিউটার দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু বন্ধুর কম্পিউটার প্রয়োজন হওয়ায় ২০১১ সালে মায়ের হাতের আংটি বিক্রি করে কেনেন কম্পিউটার নেন ইন্টারনেট সংযোগ। শুরু করেন তার নতুন জীবনের পথচলা। একের পর এক অনলাইন মার্কেটগুলোতে জন্য আবেদন করতে থাকেন। কাজও পান, প্রথম কাজে আয় করেন ৩০০ ডলার। এতে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

 

২০২১ সালে জিতু গড়ে তোলেন নতুন প্রতিষ্ঠান। রকমারি শিশুর ঘর ডটকম ও এস এম যে ডটকম নামের দুটি ওয়েবসাইট খুলে শুরু করেন পোশাক বিক্রি। এই দুই প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরির কাজ করেন আশপাশের দশটি এলাকায় দেড় হাজারের অধিক নারী। মাসে ৫ থেকে ১২০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন তারা। সম্প্রতি নগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় জিতু রায়ের কারখানার পাশাপাশি মাঠেও সুই-সুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তোলার কাজ করছেন একদল নারী।

 

মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা জিতুর কারখানায় কাজ করেন বিউটি বেগম বলেন ‘জিতু প্রতিবন্ধী হইলে কি হইবে। হামরা ওর কারখানা কাম করছি। কাপড়ে নকশা তুলি কামাই করছি। জিতু দাদার দোয়ায় আল্লাহ রহমতে আমরা সুখে আছি।’

 

কারখানায় সেলাই করা কাজ করা আছিয়া বেগম বলেন, ‘জিতুর জন্য এলা মোর সংসারত কষ্ট নাই। আগত স্বামীর কামাই দিয়া সংসার চলছিল না। সংসারে ঝগড়া নাগি আছিল। কিন্তু জিতু দাদার কারখানার কাম করিয়া মাসে ৬০০০ টাকা পাও। এখন মোড় সংসার ভালোই চলছে।’

 

ওই কারখানায় কাপড় কাটার কাজ করা আরেক নারী শ্রমিক নুসরাত জাহান বলেন,এতদিন কর্ম ছিল না এখন জিতু দাদার পোশাক তৈরির কারখানা হওয়ায় কাজ পেয়েছি। প্রতি মাসে ভালো বেতন পাচ্ছি তিনি আরো বলেন, দেশে এরকম হাজারো জিতুর জন্ম হোক এবং জিতুকে দেখে শিখুক সবাই।

 

জিতু রায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেধা, পরিশ্রম, সততা লক্ষ্য যদি থাকে সাময়িক কষ্ট-বাধা এলেও অবশ্যই মানুষের জীবনে সফলতা আসবে। তিনি বলেন, আমি আজ স্বাবলম্বী হয়ে নিজ পরিবারকে স্বাবলম্বী করেছি, সেই সঙ্গে হাজারো পরিবারকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পেরেছি এটাই আমার আত্মতৃপ্তি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version