নীলফামারীর ডোমারে পরিবেশবান্ধব অন্নপূর্ণা জৈব সারের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং সবুজ শিল্প হিসেবে খ্যাত অন্নপূর্ণা এগ্রো সার্ভিস নামের পরিবেশবান্ধব জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি দেশের সর্ববৃহৎ কেঁচো আবাদের ক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। নীলফামারী জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই জৈব সারের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে।
২০০০ সালে দেশে একমাত্র অন্নপূর্ণা জৈব সার উৎপাদন ও বিক্রির জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে যাত্রা শুরু করে।
বর্তমানে ডোমারে অবস্থিত সোনারায় আলু বীজ উৎপাদন খামার ও দেবীগঞ্জে অবস্থিত প্রজনন বীজ আলু উৎপাদন খামারসহ দেশের বিভিন্ন সুনামধন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দেশের নামিদামি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বীজ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব অন্নপূর্ণা জৈব সার ব্যবহার করছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, গম ও ভুট্টা গবেষণা কেন্দ্র দিনাজপুর, চা গবেষণা ইনস্টিউট শ্রীমঙ্গল, বিএডিসি সবজি বীজ উৎপাদন খামার রংপুর, পাট বীজ উৎপাদন খামার দিনাজপুর, আলু বীজ উৎপাদন খামার দিনাজপুর, স্কয়ার আলু বীজ উৎপাদন প্রকল্প দিনাজপুরসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। রবি মৌসুমে এ সারের চাহিদা বেশি।
জৈব সার পরিবেশবান্ধব হওয়ায় আর ভালো ফলন পাওয়ায় ধান, আলু, ভুট্টা, গম, সবজি, ফল, ফুল, ঢাকার ছাদ বাগান বিশেষ করে রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলের ক্ষুদ্র খামারিদের মাঝে জৈব সারের চাহিদা বাড়ছে। প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার এবং চাষিদের সুবিধার কথা চিন্তা করে ১ কেজি, ২ কেজি, ৫ কেজি এবং ৪০ কেজি ওজনের প্যাকেটে তৈরি করা হচ্ছে।
অন্নপূর্ণা জৈব সার কারখানায় প্রতিদিন ৩৫ জন নারী শ্রমিক কাজ করছেন। পাশাপাশি পুরুষ শ্রমিকও রয়েছেন। এখানে কেঁচো উৎপাদনের জন্য ৬০০টি বেড রয়েছে। যেখানে ১০ টনের অধিক কেঁচো রয়েছে। আফ্রিকান প্রজাতির ইউট্টিলাজ ইউজিনি জাতের এই কেঁচো সর্বোচ্চ এক ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
এদের খাওয়ার জন্য দেয়া হয় গোবর, কচুরিপানা, হাড়ের গুঁড়া, কলাগাছ, কাঠের গুঁড়া, গাছের পাতা, শুকনা পাতা, সুগার মিলের ফ্লেম মার্ক। এগুলো ৪৫ দিন বক্সে রেখে পচন প্রক্রিয়া শেষ করে সার তৈরি করা হয়।
পরিবেশবান্ধব অন্নপূর্ণা জৈব সার উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করায় ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে এবং পরিবেশবান্ধব অন্নপূর্ণা জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহারে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করায় ২০১৮ সালে কেআইবি কৃষি পদক মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন অন্নপূর্ণা এগ্রো সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী রাম নিবাস আগরওয়ালা।
সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কাছ থেকে গত ৩০ জানুয়ারি গ্রিন ইনক্লুসিভ চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড ২০২২ গ্রহণ করেন। বছরে ১২ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও বাজার ব্যবস্থাপনা, স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়াসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা থাকায় মাত্র ৩ হাজার টন সার উৎপাদন করতে পারছে।
অন্নপূর্ণা এগ্রো সার্ভিসের উৎপাদন ও প্রোডাকশন ম্যানেজার মোহন আগরওয়ালা জানান, এখানে উৎপাদিত জৈব সার পরিবেশবান্ধব হওয়ায় মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। কৃষক ও খামারিদের মাঝে দিন দিন এ সারের চাহিদা বাড়ছে।
অন্নপূর্ণা এগ্রো মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দেবরাজ আগরওয়ালা জানান, পরিবেশবান্ধব জৈব সারের ব্যবহার বাড়লে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ২৫% কমে যাবে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমে আসবে। জৈব সার ব্যবহারে কীটপতঙ্গের আক্রমণ কমে আসে। ফলে কীটনাশকের ব্যবহারও কমে আসবে। ইতিমধ্যে জৈব সার ব্যবহার ও সম্প্রসারণের জন্য জেলার ৫টি উপজেলার খামারি, ছোট ছোট উদ্যোক্তা এবং কৃষক পর্যায়ে ২ হাজার জনকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
বাণিজ্যিক কৃষি খামারে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি হলে কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বাড়বে। অন্নপূর্ণা এগ্রো সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা রাম নিবাস আগরওয়ালা বলেন, একটি ধর্মীয় বইতে পেয়েছি, ‘মাটি হচ্ছে মা। মাটি বলছে, তুমি আমাকে ১০ কেজি বীজ দিলা, ১ মণ সার দিলা। বিনিময়ে আমি তোমাকে ৫০ মণ ধান দিলাম, ৫০ মণ নাড়া দিলাম। এটা কোথা থেকে আসে।
আমি আমার শরীরের গচ্ছিত সম্পদ থেকে দিয়েছি। তুমি তো আমার সন্তান। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা আমার কর্তব্য। আমি মরে গেলে তোমার কি হবে? কাজেই তুমি তোমার স্বার্থে আমাকে বাঁচিয়ে রাখো। তাই ধানটা তুমি নাও নাড়াটা আমাকে দাও। এর থেকেই জৈব সার তৈরির চিন্তা মাথায় আসে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুস ছাত্তার মন্ডল, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ড. শহিদুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মামুন উর রশিদসহ আরো অনেক কৃষি বিজ্ঞানীর অনুপ্রেরণায় আমি এটি করতে সাহস পেয়েছি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য