দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকার ঘরবাড়িতে ফাটল ধরেছে। এ কারণে চরম আতঙ্কে রয়েছে গ্রামবাসী। ‘এক যুগ আগে অধিগ্রহণের কারণে আপন বসতভিটা ছেড়ে এক কিলোমিটার দূরে কষ্টের উপার্জনের অর্থে দালানবাড়ি গড়েছিলাম। কিন্তু তাও টিকলো না। ৪ থেকে ৫ বছরেই ফাটল ধরল আমার স্বপ্নের বাড়িতে।
ইদানিং ভারত-বাংলাদেশের তেলের লাইনের পাইপ স্থাপনের পর আরো বেশি করে ফাটল দেখা দিচ্ছে ঘরবাড়িগুলোতে। অর্থও নেই যে এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে নতুন করে আবারো বাড়ি গড়ব। কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পার্শ্ববর্তী বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকার গোপালপাড়া মৌপুকুর গ্রামের এনামুল হকের স্ত্রী ফেন্সিআরা বেগম।
শুধু ফেন্সিআরাই নয়, বাড়ি ভেঙে নিঃস্ব হয়ে খোলাস্থানে বসবাস করছেন পাতরাপাড়া শিবকৃষ্ণপুর গ্রামের আঁখি আক্তার। তিনি দিনমজুর সামেদুল ইসলামের স্ত্রী। বৃহস্পতিবার সামান্য বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে পূর্বে ফাটল ধরা তার মাটির বাড়িটি। এখন খোলা স্থানেই স্বামী, শশুড়, শাশুড়িসহ ছেলে-মেয়ে নিয়ে দিনযাপন করছেন এই গৃহবধূ। এমনই দৃশ্য যেন এখন পুরো খনি এলাকাজুড়ে।
কয়লাখনির ভূগর্ভের জমাটকৃত কয়লা ভাঙার জন্য ডিনামাইট ফাটানোর (ব্লাস্ট) কারণে এ ফাটল দেখা দিয়েছে। নড়বড়ে হয়ে পড়েছে আঁধাপাকা-কাঁচা ঘরবাড়ি। আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন গ্রামবাসী। রাতে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে পরিবারের কেউ যেন হতাহত না হয়, সেজন্য পালাক্রমে রাত জেগে থাকছেন পরিবারের একজন করে।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, ভূগর্ভে ডিনামাইট বিস্ফোরণের কারণে ঘরবাড়িতে ব্যাপকভাবে ফাটলসহ নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এমন বিষয়টি জানিয়ে খনি কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার আবেদন নিবেদন করেও কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
মঙ্গলবার খনি গেট সংলগ্ন গোপালপাড়া মৌপুকুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামটি রয়েছে খনির মূল অংশ থেকে প্রায় ৩০০ গজের মধ্যে। সেখানে রয়েছে প্রায় ২০টি বাড়ি। ভূগর্ভের কয়লা ফাটানোর জন্য ভূগর্ভে ডিনামাইট বিস্ফোরণের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের কম্পনের প্রভাবে গ্রামের দু-একটি পরিবার বাদে প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কমবেশি পাকা-আধাপাকা ও কাঁচা ঘরবাড়ি ছোটবড় ব্যাপক আকারে ফাটল দেখা দিয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে সেরাজুল ইসলামের বাড়িটি। ধসে পড়ছে পিলারসহ আস্ত একটি কক্ষ। শুধু তারই নয় ভেঙেছে ওই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকিম আলী, এনামুল হক, আনিসুল ইসলাম, সাদেকুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক, সামসুল রহমান, তসলিম উদ্দিন, তোফাজ্জল হক, তোজাম্মেল হক, সায়মাল হোসেন, মজমুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, ওহিদুল ইসলাম, ছোট এনামুল হকসহ প্রায় আরো অনেকের বাড়ি।
এলাকার বসিন্দা মো. মোস্তাকিম উদ্দিন বলেন, প্রথম দিকে ডিনামাইট বিস্ফোরণে ঘরবাড়ি কেঁপে উঠায় ঘরবাড়ির দেয়ালে সামান্য ফাটলের দাগ দেখা দিলেও প্রায় প্রতিরাতের বিস্ফোরণে ঘরবাড়ি কেঁপে উঠছে এবং ফাটলের সংখ্যা ও আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম্পনে নড়বড়ে হয়ে গেছে ঘরবাড়ি। ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করতে হচ্ছে পরিবার পরিজন নিয়ে।
খনি সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিকে কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনের পরের বছর ২০০৬ সালে খনি সংলগ্ন পাতরাপাড়া, কালুপাড়া, মৌপুকুর, বৈদ্যনাথপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ভ‚মি দেবে যেতে শুরু করে। এ নিয়ে গ্রামবাসী বিভিন্ন ব্যানারে পুনর্বাসনসহ ক্ষতিপূরণের দাবি আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে খনি কর্তৃপক্ষ ৬৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণকৃত মৌপুকুর গ্রামটি দেবে গিয়ে বর্তমানে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে।
মৌপুকুর গ্রামের বাসিন্দা সায়মাল হোসেন ও মজমুল ইসলাম বলেন, খনির কারণে ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দেয়াসহ মাটি দেবে যাওয়ার জন্য পূর্বের বাপ-দাদার ভিটেমাটি মৌপুকুর গ্রাম ছেড়ে ২০১০ সালে গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে ২০টি পরিবার নিয়ে গ্রাম গড়ে তোলা হয়। গত দু’বছর সেখানেও ঘরবাড়িতে বড় ফাটল দেখা দিচ্ছে।
মৌপুকুর গ্রামের কলেজ শিক্ষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দেয়ায় খনি কর্তৃপক্ষের কাছে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিকার চেয়ে গ্রামবাসীর পক্ষে একটি আবেদন করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় পুনরায় ৯ এপ্রিল খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর পৃথক একটি আবেদন করা হয়।
এ সময় মহাব্যবস্থাপক-জিএম (প্ল্যানিং অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন ও সারফেস অপারেশন) আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়।
মহাব্যবস্থাপক-জিএম (প্ল্যানিং অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন ও সারফেস অপারেশন) আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান চৌধুরী বলেন, খনির চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়াম এসব বিষয়গুলো দেখভাল করবে। চুক্তিতেও তাই বলা রয়েছে। ঠিকাদারের প্রতিবেদনের ওপর বিসিএমসিএল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়াম এ গত সপ্তাহ আগে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য