মো. ফিরোজ, বাউফল (পটুয়াখালী): ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল ও সিত্রাংয়ের আঘাতের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বিচ্ছিন্ন চন্দ্রদ্বীপসহ ১৮ চরাঞ্চলের মানুষ। বিগত ঘূর্ণিঝড়গুলোতে নদীবেষ্টিত এসব চরাঞ্চলে প্রাণহানিসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর আভাস দিয়েছে, আগামী রোববার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় মোখা। এমন পূর্বাভাসে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে এসব এলাকার মানুষের। এসব চরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রায়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ না থাকায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নদীবেষ্টিত ইউনিয়ন চন্দ্রদ্বীপ। ছোট বড় ১১টি চর নিয়ে এ ইউনিয়ন গঠিত। যার একটির নাম চরব্যারেট। এ চরে প্রায় ৩ হাজার মানুষ বসবাস করে। ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বসে এখনকার মানুষের নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। শুধু চরব্যারেট নয়, চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চররায়হাসেব, চরউত্তর মিয়াজান, চরকিসমত, চরনিমদী, উত্তর দিয়ারা কচুয়া, চরওয়াডেল এলাকায়ও নেই আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় চরম ঝুঁকি নিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা করেন এখানকার মানুষ। এতে ঘটে হতাহতের ঘটনা।
চরব্যারেটের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন,‘চরব্যারেটে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। আর চরের চারপাশে নদী থাকায় আমরা দূরের কোনো আশ্রয়কেন্দ্র যেতেও পারি না। আবার ট্রলারের ব্যবস্থা থাকলে ঘরবাড়ি, গরু-মহিষ রেখে কেউ যেতে চায় না।’ সাবেক ইউপি সদস্য মো. নাগর আলী হাওলাদার বলেন, চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আর চরব্যারেট চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ অতি গুরুত্বপূর্ণ।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির চন্দ্রদ্বীপ ইউপির টিম লিডার মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চন্দ্রদ্বীপে আশ্রয়কেন্দ্র সংকট রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায়ই ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। তারপরে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মীরা মানুষের সচেতনা বৃদ্ধিতে কাজ করে থাকে।
চন্দ্রদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক আলকাছ বলেন, চন্দ্রদ্বীপে ২৫ হাজার মানুষ বসবাস করে। সাইক্লোন শেল্টার আছে মাত্র ৫টি। ঝুঁকিপূর্ণ ৬টি এলাকায় নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিক বার লিখিত আবেদন করেছি। কোনো কাজ হচ্ছে না।
ধুলিয়া ইউনিয়নের নদীবেষ্টিত বিচ্ছিন এলাকা চরবাসুদেব পাশা। বাসুদেব পাশায় প্রায় ২ শতাধিক মানুষ বসবাস করেন। এখানেও কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। ঘূর্ণিঝড়ের সময় অনেকে ঘরবাড়ি ফেলে রেখে ধুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করেন। তবে অনেকে ঘরবাড়ি গরু মহিষের মায়ায় ঝুঁকি নিয়ে ওই চরেই অবস্থান করেন।
ঘূর্ণিঝড়ে আরেক ঝুঁকিপূর্ণ চরফেডারেশন। কালাইয়া ইউনিয়নের অংশ এ চর। এখানে অর্ধশত মানুষ বসবাস করে। এখানেও নেই আশ্রয়কেন্দ্র। ২০০৭ সালের সিডরে ৪৫ জন নারী, পুরুষ ও মহিলার প্রাণহানি ঘটে। তারপর থেকে অনেকেই ফেডারেশন ত্যাগ করেছেন। এখনো কয়েকটি পরিবার বসবাস করে।
এছাড়াও নদী তীরবর্তী কালাইয়া ইউনিয়নের, চরকালাইয়া, বগী, শৌলা, নাজিরপুর ইউনিয়নের নিমদী, ধানদী, তাঁতেরকাঠি, তালতলী, কেশবপুর ইউনিয়নের ভরিপাশা, বাজেমহল, চরমমিনপুর, ধুলিয়া ইউনিয়নের মঠবাড়িয়া, ধুলিয়া এলাকার মানুষও ঘূর্ণিঝড় ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। মানুষ এসব আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও বিপাকে পড়ে গবাদিপশু।
সিডরসহ বিগত ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার চরফেডারেশনে ৪৫ জন, চন্দ্রদ্বীপে ৭ জন, কেশবপুর, কালিশুরী ও কনকদিয়ায় ৫ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন। এসব চরাঞ্চলে বেড়িবাঁধ না থাকায় বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে ফসল। বিশেষ করে বোরো ধানসহ রবিশস্য। বিভিন্ন সময় নদী ভাঙন থেকে রক্ষায় ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে বেড়িবাঁধের দাবি করে আসছে এলাকাবাসী।
ধুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ন কবির বলেন, ধুলিয়ার চর বাসুদেব পাশায় কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় ওখানে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে থাকেন। আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ঝড়ের পূর্বাভাস পেলে ট্রলারে করে বাসুদেব পাশার লোকজনকে ধুলিয়ার আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে আসি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আল আমিন বলেন, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্য়োগ মোকাবিলায় মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য ১৫৭ সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়। তবে বিচ্ছিন্ন জনপদ চন্দ্রদ্বীপে তুলনামূলক কম সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। ওখানে বেশ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণলয়ে প্রস্তাব পাঠাব।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য