‘দিনে-রাইতে ১৫ ঘণ্টা কারেন্ট থাকোছে না, মরণ গরমোত হামার ফ্যান চলোছে না। সারা রাইত চেতন থাকি, সকালে কৃষাণি করিবার পারুছি না। আর কদ্দিন এইংক্যা করি চলবার নাগবে। জীবন আর বাঁচোছে না।’ ঘনঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন তারাগঞ্জের ইকরচালী গ্রামের দিনমজুর বাদশা মিয়া। রংপুর নগরীর শাহিপাড়া গ্রামের রুকন মিয়ার চার ছেলেমেয়ে।
ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে সংসার চালান তিনি। আগে সারা দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করে সংসার চালাতেন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে গাড়িতে ঠিকমতো চার্জ করাতে না পারায় এখন সেই আয় ঠেকেছে ৩০০-৪০০ টাকায়। এ টাকায় ঊর্ধ্বমুখী বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
রুকন মিয়া বলেন, ‘ভাই, না পাওছি ঠিক মতো ঘুমবার, না পাওছি খাবার। কামাই তো নাই। সারা দিনে-রাইতে মিলে অর্ধেকও চার্জ হয় না। খুব কষ্টে বাঁচি আছি।’ এমন আক্ষেপ শুধু বাদশা মিয়া ও রুকন মিয়ারই নয়, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে রংপুর জেলার মানুষের জনজীবন। জেলা শহরে দিনেরাতে প্রায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলেও গ্রামে থাকছে না ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা।
বিশেষ করে রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকায় ঘুমহারা হয়ে উঠেছে মানুষ। এতে স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। কমছে কর্মঘণ্টাও। বিদ্যুতের যাওয়া-আসায় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। লোডশেডিংয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন পোলট্রি খামারিরা।
তবে নেসকো ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্র বলছে, রাতের বেলায় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকায় এ লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনের বেলায়ও চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে। এটি জাতীয় সমস্যা। ইকরচালীর লেদ মেকানিক মহুবার হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিল তো ঠিক দেওচি, কারেন্ট তো পাওছি না। কারেন্ট না থাকায় ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছি না। বসে রেখে ৫ জন কর্মচারীকে বেতন দেওচে।’
চার মাসের কোলের শিশুকে হাসপাতালে নেয়ার সময় বামনদীঘি বাজারে কথা হয় হাড়িয়ারকুঠির গৃহবধূ মন্নুজা বেগমের সঙ্গে। গরমে ঘাম বসে গিয়ে তার শিশু অসুস্থের কথা জানিয়ে বলেন, ‘রাইতোত ২ ঘণ্টাও কারেন্ট থাকোছে না। ১১ টার সময় যায় আর ভোর ৫টায় আইসে। সারারাইত শরীর দিয়া ঝরির মতোন ঘাম পড়ে ঘুম হয় না। কোলার ছাওয়াটা ঘামতে ঘামতে অসুস্থ হয়া গেইছে। হাসপাতাল নেওছুন।’
বদরগঞ্জ উপজেলার আমরুলবাড়ি গ্রামের মনোয়ার হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘সকালে খাওয়ার সময়ে বিদ্যুৎ পাই না। দুপুর ও সন্ধ্যায়ও পাই না। দিনের বেলা গড়ে ২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। রাত ১১টার পর বিদ্যুৎ আসলেও শুরু হয় সারারাত যাওয়া-আসার খেলা। বিদ্যুতের এই খেলায় ঠিকভাবে ঘুম হচ্ছে না।’
ওই গ্রামের গৃহবধূ দুলালী বেগম বলেন, ‘প্রচন্ড গরমে জীবন যাও যাও অবস্থা হয়েছে। আর এই সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। এভাবে চলতে থাকলে জীবন বাঁচা মুশকিল হবে।’ পৌরসভার শাহাপুর গ্রামের গৃহবধূ লিমা আক্তার বলেন, ‘রান্না করার সময়ে বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। সন্তানের লেখাপড়া, রাতের খাওয়া ও নামাজের সময়েও বিদ্যুৎ মিলছে না।’
ওই গৃহবধূ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যখন বিদ্যুতের দরকার তখন পাচ্ছি না। তাহলে বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকি লাভ কী?’
রংপুর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২ বদরগঞ্জ জোনাল কার্যালয়ে সূত্রে জানা গেছে, ‘এ উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ২০ মেগাওয়াট। কিন্তু এর বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ৭ থেকে ৮ মেগাওয়াট।’
ওই কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ফখরুল আলম বলেন, ‘বর্তমানে বিদ্যুৎ সংকটে সারা দেশ। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাচ্ছি না। তাই কিছুটা লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। তবে সমস্যা বেশি দিন থাকবে না। আপাতত এটা গ্রাহকদের মেনে নিতে হবে।’
নেসকোর রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, রংপুর বিভাগে বিকেল ৩টা পর্যন্ত নেসকো ও পিবিএসের ৯০৪ মেগাওয়াটের বিপরীতে ৬৬৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ মিলছে। লোডশেডিং ছিল ২৩৭ মেগাওয়াট। রাতের বেলা কুইক রেন্টালগুলো বন্ধ থাকায় সে সময় একটু বেশি লোডশেডিং বৃদ্ধি পায়।
রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর স্থানীয় উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মোহাম্মদ আব্দুল জলিল বলেন, ‘গঙ্গাচড়া উপজেলা ২০ থেকে ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে। কিন্তু এখন পাচ্ছি ৮ থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তাই দৈনিক ১ ঘন্টা পর পর ১ ঘণ্টা লোডশোডিং দেয়া হচ্ছে।’
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য