-->
শিরোনাম

বাদাম চাষে তিস্তা চরের মানুষের ভাগ্য বদল

বাবলুর রহমান বারী, রংপুর
বাদাম চাষে তিস্তা চরের মানুষের ভাগ্য বদল
রংপুরে পল্লিতে বাদাম শুকাতে ব্যস্ত নারী

একসময়ের খরস্রোতা তিস্তাকে এখন মরা নদী বলা যায়। শীত মৌসুমে তিস্তা নদীর বুকে জেগে ওঠে ছোট-বড় বেশকিছু চর। এসব চরে তখন পা পরে মানুষের। কিছু দিনের মধ্যে চরগুলো ছোট ছোট সবুজ গাছে ভরে যায়। থোকায় থোকায় ধরে বাদাম। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় প্রতি বছর এভাবে বাদামের চাষ হয়। এই আবাদ দিন ফিরিয়েছে অনেক চাষির। যারা একসময় শ্রমিকের কাজ করতেন। তারাও বাদাম চাষ করে নিজেদের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন।

 

কৃষক ও কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৫ বছর আগেও গঙ্গাচড়ায় এভাবে বাদামের চাষ হতো না। বেলে-দোআঁশ মাটিতে বাদাম চাষ অনেক বেশি লাভজনক সে বিষয়টি প্রথমে বুঝতে পারেন দক্ষিণ কোলকোন্দ ইউনিয়নের মিয়াজী পাড়া গ্রামের লাল মিয়া (৫৫)। তার সাফল্য দেখে এগিয়ে আসে আরো অনেকেই। আগে যারা চরে ধানসহ অন্য ফসলের চাষ করতেন, তারাও বাদাম চাষে ঝুঁকে পড়েন।

 

লাভ বেশি হওয়ায় বাদাম চাষ হয়ে ওঠে এখানকার মানুষের জীবনের প্রধান অবলম্বন। গোটা উপজেলায় এখন ৩৬৫ হেক্টর জমিতে বাদামের চাষ হচ্ছে। উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে মিয়াজীপাড়া গ্রামের লাল মিয়ার বাড়ি। কাঁচা-পাকা পথ ধরে তার বাড়ি যাওয়ার পথে মাঠের পর মাঠজুড়ে বাদাম খেতের দৃশ্য নজর কাড়ে। সামনে-পেছনে যেদিকে চোখ যায় বাদাম আর বাদাম।

 

কেউ রাস্তার পাশে বাদাম শুকাতে ব্যস্ত, কেউ জমি থেকে তুলছে গাছসহ বাদাম। কেউ বা শিকড় থেকে বাদাম আলাদা করছেন। অন্যদের মতো লালা মিয়াও দিনমজুর নিয়ে বাড়ির পাশে চরে শিকড় থেকে বাদাম ছাড়াচ্ছেন। সাংবাদিক পরিচয় শুনে বাড়ির উঠানে বসতে দিয়ে শোনান বাদাম চাষের গল্প।

 

১৯৫৫ সালে জন্ম লাল মিয়ার। তার বাবার নাম জব্বার মিয়া। ৬ ভাই বোনের মধ্যে তিনি মেজো। বাবার অভাবের সংসার, তাই লেখাপড়া করা হয়নি। গ্রামে ঘুরে হাঁস-মুরগির ডিম সংগ্রহের পর তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। ২০০৯ সালে তিনি ডিম সংগ্রহের জন্য লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার ঘোনাবাড়ি গ্রামে যান। তার কষ্টের কথা শুনে ওই গ্রামের মেহের উদ্দিন তাকে বাদাম চাষের পরামর্শ দেন।

 

ফেব্রুয়ারি মাসে লাল মিয়া অন্যের ২৭ শতক জমি বর্গা নিয়ে মেহেরের কাছে বীজ এনে বাদাম চাষ করেন। ১২০ দিনের মাথায় বাদাম ধরে। ফলন দেখে লাল মিয়ার মুখে হাসি ফুটে। এ বাদাম বিক্রি করে আয়ও আসে ৬ হাজার ৯৫০ টাকা। এরপর পুরোপুরি বাদাম চাষে লেগে পড়েন। প্রথম বছরের লাভের টাকা দিয়ে পরের বছরে অন্যের ৬০ শতক জমি বর্গা নিয়ে বাদাম লাগান। এবারও তার বাদামের ফলন ভালো হয়।

 

বাদাম বিক্রি করে খরচ বাদে আয় করেন ১৫ হাজার টাকা। এরপর পুরোপুরি বাদাম চাষে লেগে পরেন। বাদাম চাষ করে লাল মিয়া তিন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো বর দেখে বিয়ে দিয়েছেন। করেছেন টিনের বাড়ি। কিনেছেন ৩৫ শতক আবাদি জমি। আছে ছয়টি গাভি। এবারে দেড় একরে করেছেন বাদাম চাষ। ইতিমধ্যে জমি থেকে বাদাম তুলে রোদে শুকাচ্ছেন। এ বাদাম বিক্রি করলে খরচ বাদে আয় হবে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

 

শুধু লাল মিয়া নন কোলকোন্দ, সিংগীমারী, লোহানী, বিনবিনার চর, লক্ষীটারী, মুটুকপুর, ঢাকেরচর, খালারচরের অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে বাদাম চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন।

 

বিনবিনার চরের সফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ বছর আগে লাল মিয়াকে দেখে বাদাম চাষে উৎসাহিত হই। তিন সন্তানের মধ্যে আমার দুই সন্তানেই বাদাম চাষ নিয়ে আছে। দেড় একর জমি, পাকা বাড়ি হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে লাভ বেশি হয় বলে এবার তিন একরে বাদামের চাষ করেছি।

 

প্রতি বছরের মতো এবারও এক একর জমিতে বাদাম চাষ করেছেন মিয়াজীপাড়া গ্রামের কৃষক লাবু মিয়া। দিনমজুরদের সঙ্গে বিনবিনার চরে বাদাম তুলতে ব্যস্ত তিনি।

 

জানতে চাইলে লাবু মিয়া বলেন, ধানের চেয়ে বাদাম চাষে লাভ দ্বিগুণ। এক একর জমিতে বোরো ধান চাষ করতে ব্যয় হয় ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। উৎপাদিত ধান বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৩ হাজার টাকা। এতে লাভ হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু এক একরে বাদাম চাষ করতে ব্যয় হচ্ছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

 

বাড়ির উঠানে বাদাম শুকাতে ব্যস্ত পীরেরহাট গ্রামের মোস্তফা কামাল। আগে দেড় একর জমিতে ধান চাষ করে ৮ সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতেন। ৬ বছর থেকে বাদাম চাষ করে ৬০ শতক জমি কিনেছেন। করেছেন টিনের বাড়ি।

 

মোস্তফা কামাল বলেন, ‘চরের মাটিত এ্যালা সোনা ফলোছে। বাদাম চাষ করি মেলা মানুষ ভাগ্য ঘুচাইছে। তিনবার চাষ করি জমিতে বাদামের বীজ ছিটপার নাগে। চার মাস পর জমি থাকি থোকায় থোকায় বাদাম তুলি। তেমন ওষুধপাতি নাগে না। খাটুনিও কম।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version