পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার কয়েকটি চরে সুন্দরী কাঠ ও গোলপাতার সর্ববৃহৎ ভাসমান বাজার হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল। বিক্রির জন্য গোলপাতা ও সুন্দরী কাঠ সন্ধ্যা নদীতীরবর্তী উপকূলে জেগে ওঠা চরে চলত রমরমা ব্যবসা। কালের বিবর্তনে সুন্দরী কাঠের দুষ্প্রাপ্যতা এবং গোলপাতা ব্যবহারের স্বল্পতার কারণে থমকে পড়ে বিশাল আকৃতির ভাসমান বাজারের রূপরেখা। শুরু হয় দেশীয় কাঠের ভাসমান বাজার।
নেছারাবাদ থানাসংলগ্ন সন্ধ্যা নদীর শাখা, সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনের খালের চর, ইন্দেরহাট খালের মোহনা, মিয়ারহাট বাজারের খাল ও বয়াসহ নানা স্থানে গড়ে ওঠা ভাসমান বাজারটি এখন নেছারাবাদের সব থেকে বড় কাঠ ব্যবসাকেন্দ্র। এ ব্যবসার মাধ্যমে এখানে ব্যবসায়ী ও শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
এটি দক্ষিণাঞ্চলের তথা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাঠের বাজার। সর্ববৃহৎ কাঠের বাজার হওয়া সত্ত্বেও এখানে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঠের চরের হাটে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবসায়ীরা সহজ ও স্বল্প লভ্যাংশ ব্যাংকিং সুবিধা না পাওয়া, ব্যবসায়ী নামে দালালচক্রের উৎপাত, নদীপথে জলদস্যুদের আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বৃক্ষ বিনাশসহ নানা কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ব্যবসা ঐতিহ্যক্রমে বিলীনের পথে।
জানা যায়, আনুমানিক ১৯১৭ সালের প্রথম দিকে পিরোজপুর এলাকার তৎকালীন বাকেরগঞ্জের আওতাধীন বর্তমান নেছারাবাদ উপজেলায় সুন্দরবনের সুন্দরী গাছকে কেন্দ্র করে কাঠ ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়। ১৯১৮ সালের শেষদিকে নেছারাবাদের সন্ধ্যা নদীর তীরঘেঁষে একাধিক শাখা খালে গাছ বেচাকেনার জন্য ভাসমান কাঠের হাট গড়ে ওঠে।
সুন্দরী কাঠ ব্যবসায় সরকারের বাধা-নিষেধের পর থেকেই নেছারাবাদে গড়ে ওঠে মেহগনি, চম্পল ও রেইনট্রিসহ নানা দেশীয় কাঠের বৃহত্তর কাঠ বাজার। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা উপজেলার কাঠ মোকামগুলোর কাছ থেকে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার কাঠ কেনেন। আর এসব মালামাল ট্রাক, লঞ্চ ও কার্গোসহ বিভিন্ন পরিবহনে ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান স্ব স্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পরিবহন সংকট ও পাইকারি ক্রেতার অভাবে সরবরাহ করা কাঠ নিয়ে প্রায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নেছারাবাদের কাঠ ব্যবসায়ীরা। সময়মতো পরিবহন সংকটে গাছ বিক্রি বন্ধ থাকায় ঋণের বোঝা দিন দিন ভারী হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও বরিশাল, খুলনা, চাঁদপুর, বাগেরহাট, মুলাদী, মুন্সীগঞ্জ, যশোর, ঝিনাইদহ, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বাগেরহাট ও হবিগঞ্জসহ দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখনো স্বরূপকাঠির এই ভাসমান কাঠের হাটে ব্যবসায় জড়িত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাঠের মোকাম গড়ে তুলছেন। নদীপথে দূর থেকে আসা কাঠ ব্যবসায়ীরা জলদস্যুদের ভয়ে ২৫-৩০টি নৌকার বহরে একই সঙ্গে স্বরূপকাঠির মোকামে আসে। কাঠ বেচাকেনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা একই সঙ্গে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া আবার গল্প-গুজব করেন। যে যার মতো বেচাকেনা শেষে আবার সারিবদ্ধ নৌকাগুলো নদীপথে চলে যায়।
নেছারাবাদের কাঠ ব্যবসায়ী মতিউর রহমান মৃধা বলেন, একটি গাছ চূড়ান্তভাবে ব্যবহারের আগে ৫-৬ বার বেচাকেনা হয়। দাঁড়ানো গাছ কাটা থেকে ব্যবহারের পর্যায় পর্যন্ত ৮ ধরনের শ্রমিক রয়েছে।
নেছারাবাদের কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির কাছে এই কাঠ ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, দেশের বড় চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা ছেড়ে জীবিকার অন্বেষণে অন্য কোনো কাজকর্মে চলে যেতে হবে। বর্তমানে কাঠের দাম অনুযায়ী ব্যবসা করা যাচ্ছে না।
এদিকে উপজেলার কাঠ ব্যবসার প্রচার ও প্রসার দেশজুড়ে পরিচিত লাভ করায় এ ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে কাঠ ব্যবসার সঙ্গে জড়াচ্ছে শিক্ষিত বেকার যুবকরাও। তারা বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করে পরিবার নিয়ে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছিল। নানান প্রতিক‚লতার কারণে কাঠবাজারে ক্রেতা না থাকায় মহাশঙ্কায় পড়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন যুবক ব্যবসায়ী জানান, ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। ঋণের চাপে রাতে বাসায় থাকতে পারছি না। ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে উঠেছে আমাদের ঋণের বোঝা। সরকার যদি স্বল্প সুদে আমাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে ঋণের বোঝা কাটিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারতাম।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুব উল্লাহ মজুমদার বলেন, নেছারাবাদের নানাবিধ ঐতিহ্যে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে কাঠের ব্যবসা অন্যতম। ব্যবসার পরিধি বাড়ানো ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তায় উপজেলা প্রশাসন সবসময় নজর রাখছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য