শেরপুরের অলিগলিতে বিক্রি হচ্ছে এলপি গ্যাস, পেট্রল, অকটেন। হাঁড়ি-পাতিলের দোকান থেকে শুরু করে পানের দোকানেও মিলছে এসব ঝুঁঁকিপূর্ণ দাহ্য পদার্থ। বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত এলপি গ্যাস দিয়ে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলার।
অভিযোগ রয়েছে, শেরপুরের পাঁচ উপজেলায় জমে উঠেছে বিপজ্জনক জ্বালানির ব্যবসা। ট্যাংক ও লরিতে করে এসব দাহ্য পদার্থ বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করছেন কয়েকটি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। অথচ বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ভাষ্য, ফিলিং স্টেশন ছাড়া পেট্রল-অকটেন বিক্রি করতে পারবেন না কেউ।
যত্রতত্র গ্যাস, পেট্রল ও অকটেন বিক্রির লাইসেন্স ও অনুমোদন নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। বিস্ফোরক অধিদপ্তর বলছে, জ্বালানি খনিজ মন্ত্রণালয়ের বিধিমালা অনুযায়ী, এলপি গ্যাস ১২৫ লিটার পর্যন্ত বিনা লাইসেন্সে বিক্রি করা যাবে। অর্থাৎ ১০টি সিলিন্ডার গ্যাস বোতল যে কেউ বিক্রি করতে পারেন। তবে ১২৫ লিটারের স্থলে ১২৬ লিটার হলেই বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, ১৯৬১ সালের ইস্ট পাকিস্তান ফায়ার সার্ভিস ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্যাস বিক্রির লাইসেন্স দিতে পারে তারা। আবার জেলা প্রশাসন এবং পৌরসভাও তেল-গ্যাস বিক্রির লাইসেন্স দিচ্ছে। এসব কারণে তেল-গ্যাস বিক্রেতারাও নানা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
জেলা শহরের তিনআনী বাজারের আহমেদ ট্রেডার্স বিডি নামে একটি দোকানে দেখা গেছে, গ্যাসের চুলাসহ অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডার মজুত রেখে বিক্রি করা হচ্ছে। নেই কোনো বৈধ লাইসেন্স ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। যে কোনো সময় ঘটতে পারে অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা। দোকানটির মালিক আহমদ নোমানের ভাষ্য, তাকে গ্যাস বিক্রির লাইসেন্স দিয়েছে পৌরসভা।
পরে তার ট্রেড লাইসেন্সে দেখা যায়, শেরপুর পৌরসভা ১ হাজার ৮৪০ টাকা ফি নিয়ে তাকে এলপি গ্যাস ও গ্যাসের চুলা বিক্রির লাইসেন্স দিয়েছে। ঝিনাইগাতী শহরে পান, মুদি, হাঁড়ি-পাতিল ও ইলেট্রনিকস দোকান, এমনকি প্রসাধনীর দোকানেও বিক্রি হচ্ছে এলপি গ্যাস, পেট্রল ও অকটেন।
কথা হয় বাজারের ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের মালিক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তার ভাষ্য, পেট্রল, অকটেন বিক্রির জন্য ফায়ার সার্ভিস থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছেন তিনি। এসব জ্বালানি তাকে সরবরাহ করে বড় বড় কোম্পানির লোকজন। একই শহরের শামসুল স্টোর অ্যান্ড টেলিকমে গিয়ে দেখা গেছে, হাঁড়ি-পাতিল, বালতি-চেয়ার বিক্রির পাশাপাশি গ্যাসও বিক্রি হচ্ছে সেখানে।
জানতে চাইলে দোকানি বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে গ্যাস বিক্রির লাইসেন্স নিয়েছেন তিনি।
বাজারের নাহার স্টোর অ্যান্ড টেলিকমের মালিক গ্যাস বিক্রির জন্য ফায়ার সার্ভিসের অনুমতিপত্র দেখান। তা পড়ে দেখা যায়, সেটি লাইসেন্স নয়। গ্যাস বিক্রির জন্য অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণের জন্য অনাপত্তিপত্র। ওই অনাপত্তিপত্রে প্রতিদিন ১৫টি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির জন্য বিভিন্ন শর্ত দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম গ্যাস বিক্রি করতে হলে ঘরের সামনে ৩০ ফুট জায়গা ও জলাধারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু ওই দোকানে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। তবে এ অনাপত্তিপত্রের জন্য দোকানদারকে গুনতে হয়েছে কয়েক হাজার টাকা। অথচ ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ৭৫০ টাকা ফি লাগে অনাপত্তিপত্রে।
পেট্রল-অকটেন বিক্রির জন্য ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। অথচ ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের হাবিব ট্রেডার্সের মালিক মিজানুর রহমান মিজানকে মনিহারি পণ্য ও খুচরা জ্বালানি তেল বিক্রির লাইসেন্স দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ওই লাইসেন্স নিয়ে দেদার বিক্রি করছেন অকটেন, পেট্রলসহ দাহ্য পদার্থ। শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, তিন উপজেলায় পাঁচ শতাধিক খুচরা দোকানে বিক্রি হচ্ছে এলপি গ্যাস, পেট্রল ও অকটেন। তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দাবি, এ পর্যন্ত শুধু নালিতাবাড়ীতে শতাধিক দোকানে অগ্নিনির্বাপক ও গ্যাস বিক্রির লাইসেন্স দিয়েছেন তারা।
দাহ্য পদার্থ বিশেষ করে এলপি গ্যাস, পেট্রল ও অকটেন যেখানে সেখানে বিক্রি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সমাজকর্মী নূরুল ইসলাম হিরো। তিনি বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় কাউকে তোয়াক্কা না করে গ্যাস সিলিন্ডার, অকটেন, পেট্রল বিক্রি হচ্ছে। তারা দেখেও না দেখার ভান করছে। তাদের আশঙ্কা, সামনে নির্বাচন। দুর্বৃত্তরা অকটেন-পেট্রল দিয়ে বোমা তৈরি করে সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে।
এ বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক সানজিদা আক্তার জানান, দুই হাজার লিটারের অধিক দাহ্য পদার্থ বিক্রি করতে জেলা প্রশাসকের অনাপত্তি নিয়ে তাদের কাছে আবেদন করতে হবে। পরে যাচাই-বাছাই করে লাইসেন্স দেবেন তারা।
অকটেন ও পেট্রল বিক্রির ক্ষেত্রে তিনি বলেন, ফিলিং স্টেশন ছাড়া কেউ পেট্রল-অকটেন বিক্রি করতে পারবেন না। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এলপিজি বিধিমালা-২০০৪ অনুযায়ী ১০টি এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করলে তাদের তদারকির আওতায় পড়বে না।
শেরপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক জাবেদ হোসেন মো. তারেক বলেন, ১৯৬১ সালের ইস্ট পাকিস্তান ফায়ার সার্ভিস ম্যানুয়াল অনুযায়ী তারা গ্যাস বিক্রির লাইসেন্স দিতে পারেন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য