-->
শিরোনাম

ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী ৭২, যেতে চায় বহুদূর

বাবুল আহমেদ, মানিকগঞ্জ
ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী ৭২, যেতে চায় বহুদূর
মানিকগঞ্জে ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষক

চটপটে তরুণ। কখনো খাবার আনছে, কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বারান্দা পরিষ্কার করছে, অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, খাবারের আয়োজন করছে। কিন্তু তার মুখে ভাষা নেই। কথা বলতে জানে না। এক সময় ব্লুমসের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বয়স বাড়লে তাকে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী হিসেবে কাজ দেয়া হয়। নাম আলমগীর হোসেন (২২)। তার মতো বাক ও শ্রবণ সমস্যা নিয়ে আরো সাতজন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছে।

 

প্রতিষ্ঠানটিতে ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি, সিলেকটিভ নিউট্রিজম, অটিজম, স্পিস আ্যান্ড হেয়ারিং, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅর্ডার, ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি, ডিমেনশিয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা আক্রান্ত ৭২ জন শিক্ষার্থী শিক্ষা নিচ্ছে। পাশাপাশি প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে। থেরাপি দেয়ার কাজ করছেন দুজন ফিজিও থেরাপিস্ট। স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট, ইশারা ভাষা প্রশিক্ষক কাজ করছেন। দাপ্তরিক কাজের জন্য রয়েছেন হিসাবরক্ষক।

 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার আটিগ্রাম ইউনিয়নের বাসাইল গ্রামে সবুজেঘেরা রবিউল করিমের মায়ের দেয়া ২৯ শতাংশ জায়গার ওপরে গড়ে উঠেছে একতলা পাকা ভবনের ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়। পাশে একটি চৌচালা টিনের ঘর। ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ চৌচালা টিনের ঘরে ১১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন রবিউল করিম। ধীরে ধীরে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। রবিউল করিমের অক্লান্ত পরিশ্রমে তার সঙ্গে এ যাত্রায় যোগ দেন তার কয়েকজন বন্ধু। পরবর্তীতে সম্মিলিতভাবে এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা শুরু হয়।

 

বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়ার জন্য রয়েছে দুটি ভ্যান। চালু রয়েছে মিড-ডে মিলও। আর এসব কিছু শিক্ষার্থীরা পায় বিনা খরচে। ব্লুমসের এ অগ্রযাত্রায় ধাক্কা লাগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই। এই দিনে ব্লুমসের প্রতিষ্ঠাতা রবিউল করিম দায়িত্ব পালনকালে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের হাত থেকে জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে স্পিন্টারেরে আঘাতে মারা যান। নৃশংস সেদিনের ঘটনায় সমগ্র জাতি স্তব্ধ হয়ে যায়। রবিউল করিম সে সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

 

ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের একতলা ভবনে তিনটি কক্ষ। যার একটিতে শ্রেণিকক্ষ, অপরটিতে থেরাপি ও অন্যটিতে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রশাসনিক কক্ষের দেয়ালে ছড়িয়ে রয়েছে রবিউলের বিভিন্ন সময়কালের ব্লুমসের প্রতি তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির নানা উপাদান। কথা হয় আফসানা আক্তারের সঙ্গে। তিনি সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত।

 

১৭ বছর বয়সি আফসানা ব্লুমসে আসে যখন তার বয়স পাঁচ বছর। আফসানা রবিউল করিমকে চিনত বড় স্যার হিসেবে। সে বলে, ‘বড় স্যার থাকলে আমাগো আরো ভালো হইত। স্যার আমাগো অনেক আদর করত। স্যার স্কুলে আইসা আমাগো সাথে বইসা ক্লাস করত। স্যাররে আল্লাহ ভালো রাখুক।’

 

রবিউল করিমের গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে রয়েছে। প্রতিমাসে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদ। নানাজনের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে মেটানো হচ্ছে আর্থিক সংকট। তবে সাময়িকভাবে এ সংকট মোকাবিলা করা গেলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।

 

ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছোট্ট একটি টিনের ঘরে ১১ শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলের যাত্রা শুরু করেছিলেন রবিউল করিম। এখন এখানে ৭২ জন শিক্ষার্থী। সবাইকে বিনামূল্যে শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, দুপুরের খাবার, পোশাক ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এখানে প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয় হয়। প্রতিমাসে অর্থের সংকুলান করতে বেগ পেতে হচ্ছে। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে এই পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমাজের মূলধারার যুক্ত করার কার্যক্রম সচল রাখা সহজ হবে।

 

ব্লুমস কাটিগ্রামের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সচিব শামসুজ্জামান শামস বলেন, ব্লুমস সবার প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটির সফলতার মধ্য দিয়ে রবিউল করিমের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে। তবে বর্তমানে স্কুলটি পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে। এজন্য সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version