অধিক ফলনের আশায় মেহেরপুরে কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের সঙ্গে বাজারের খোলা লবণ ও পটাসিয়াম সালফেট ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মাটির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা দিন দিন কমছে। এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে আবাদি কৃষি জমি।
মেহেরপুর কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মেহেরপুরে বর্তমানে আবাদি জমির সংখ্যা ৫৮ হাজার ৫০৭ হেক্টর। যা বিগত ৫ বছরের তুলনায় কম। জমির শ্রেণি পরিবর্তন, বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও পুকুর খনন ইত্যাদি কারণে গত ৫ বছরে কমেছে প্রায় ২শ হেক্টর আবাদি জমি। তবে সরকারি হিসাবে আবাদি জমি কমেছে মাত্র ১০ হেক্টর। এ ছাড়াও কৃষিনির্ভর মেহেরপুরে বেশিরভাগ চাষিই অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করে।
এসব জমিতে অধিক ফলনের আশায় ব্যবহার করা হয় উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার, কখনো কখনো পটাসিয়াম সালফেট। কৃষি বিভাগ বলছে, দীর্ঘমেয়াদি রাসায়নিক সার বা লবণ জাতীয় সার কৃষি জমিতে ব্যবহারের ফলে পিএইচ (পাওয়ার অব হাইড্রোজেন-অমলত্ব ও ক্ষারত্বের পার্থক্য) এর মাত্রা কমে যাচ্ছে। ফলে মাটি অ্যাসিডিক হয়ে যাচ্ছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, মেহেরপুর একটি কৃষি নির্ভরশীল জেলা। এ জেলার মাটি অত্যন্ত উর্বর। ফসলের নিবিড়তা দেশের যেকোনো জেলা থেকে বেশি। এ জেলার অধিকাংশ জমি উঁচু এবং কোনো জমিই পতিত থাকে না। একটি জমিতে বছরে ৩ থেকে ৬টি পর্যন্ত ফসল হয়। কিন্তু ইদানীং ভুট্টা, পেঁয়াজ, কলা, তামাক ও অন্যান্য উচ্চমূল্যের ফসলে গবেষণার সুপারিশকৃত সার থেকে দ্বিগুণ সার ব্যবহার করা হচ্ছে, যা জমির উর্বরতার জন্য খুবই ক্ষতিকর। রাসায়নিক সার ও সাথে লবণ বেশি ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে তা ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত অর্থবছরে মেহেরপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন মাঠ থেকে আমরা মাটি পরীক্ষা করেছি, তাতে দেখা যায় প্রায় সব মাঠের মাটির পিএইচের মান ৬ এর নিচে, যা ৭ এর উপরে হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ মাটি এসিডিক হয়ে যাচ্ছে এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ শতকরা ২ ভাগের নিচে, যা আদর্শ মাটির জৈব উপাদান শতকরা ৫ ভাগ থাকার কথা। এটা মাটির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের ইঙ্গিত।
জেলার বেশকিছু চাষির দাবি ১ সিজনের জন্য বিঘাপ্রতি ১২-১৫ হাজার টাকা জমি মালিককে লিজ খচর দিতে হয়। সেই টাকা বাদে আরো উৎপাদন খরচ আছে। সব মিলিয়ে আমরা চেষ্টা করি যেকোনো উপায়ে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করা। তাই রাসায়নিক সারের পাশাপাশি কিছু পরিমাণ লবণ অথবা সালফেট ব্যবহার করি। বর্তমানে দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল ছাড়িয়ে এই লবণাক্ততা আক্রান্ত অঞ্চল ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ২০০৯ সালের লবণাক্ততা জরিপের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত। লবণাক্ততার কারণে এই এলাকার শস্য নিবিড়তা মাত্র ১৩৩ শতাংশ। যদি সার প্রয়োগের মাত্রা না কমে তাহলে ধীরে ধীরে আবাদি জমিগুলো অনাবাদি হয়ে যাবে বলে মনে করেন কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল মওলা।
এ অবস্থায় শস্যভান্ডার খ্যাত মেহেরপুরের কৃষির ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার পরিহার করে পরিমিত সার ব্যবহার করতে হবে। পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সঙ্কর কুমার মজুমদার।
তিনি বলেন, সম্ভব হলে বছরে একবার জমিতে পাট অথবা ডাল জাতীয় ফসল চাষ করতে হবে। এতে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া সম্ভব হলে জমিতে ধৈঞ্চা চাষ করা যেতে পারে। তাহলে মেহেরপুরের জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য