-->
শিরোনাম

ধান-চাল সংগ্রহ, অনিয়মই পরিণত হয়েছে নিয়মে

নড়াইল প্রতিনিধি
ধান-চাল সংগ্রহ, অনিয়মই পরিণত হয়েছে নিয়মে
তিন বছর ধরে বন্ধ নড়াইল সদর উপজেলার উজিরপুরে অমিত রাইস মিল

নড়াইলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ধান-চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনিয়মই পরিণত হয়েছে নিয়মে। এ জেলায় প্রকৃত কৃষকসহ লটারির মাধ্যমে নির্বাচিতরা গুদামে ধান-চাল দিতে পারছেন না। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে মিল বন্ধ থাকলেও মিল মালিকসহ সিন্ডিকেট নামধারী একশ্রেণির ব্যবসায়ী লটারিতে নির্বাচিত কৃষকদের নামে ধান-চাল গুদামে দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ব্যাংক থেকে তাদের নামে টাকাও তুলে নেয়ার অভিযোগ মিলেছে।

 

সরকারি তথ্য বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে সরকারি নির্ধারিত ৩০ টাকা কেজি দরে ১ হাজার ৯৬৫ টন ধান ও ৪৪ টাকা কেজি দরে ১৪টি চালকল থেকে ২ হাজার ৭২৬ টন চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয় গত ২৪ মে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৫৩ টন ধান এবং ১ হাজার ৯২১ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। অভিযান চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

 

সরেজমিনে বিভিন্ন কৃষক ও স্থানীয় ধান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন কৃষকরা গুদামে ধান-চাল দিতে পারছেন না। একটি সিন্ডিকেট ও কয়েকজন মিল মালিক মিলে গোটা প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা বিভিন্ন এলাকার গরিব কৃষকদের কৃষি কার্ড, ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে লটারিতে তাদের নাম তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনের ব্যবস্থা করেন।

 

পরে ওই কৃষক লটারিতে তালিকাভুক্ত হলে তাদের সইসহ ব্যাংকের চেক রেখে দেয়া হয়। পরে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা নিজের লোক দিয়েও বিভিন্ন হাটবাজার থেকে ধান কিনে খাদ্যগুদামে রাখছেন। এসব ধান ঠিক আছে কিনা, নির্দিষ্ট আর্দ্রতা পরিমাপ করে বস্তাবন্দি করা হচ্ছে কিনা এসব দেখার কেউ নেই।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুদামের শ্রমিকরা জানান, খাদ্যগুদাম এখন সিন্ডিকেট ও মিল মালিকরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। মিলার বাইরে থেকে চাল কিনে গুদামে সরবরাহ করছেন। আবার কোনো কোনো চালকল মালিক চালের এক চালান নিজের মিল থেকে গুদামে দিয়ে পরে বাইরে থেকে কিনে দেন।

 

সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের পাঁচুরিয়া এলাকার অমিত রাইস মিল এবার ৫২ দশমিক ৫৩৩ টন চাল সরবরাহের বরাদ্দ পেয়েছে। নড়াইল পৌরসভার উজিরপুর গ্রামে তার চালকল। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, চালকল ঘরের চারপাশ বনজঙ্গলে ভরা। স্থানীয় বাসিন্দা রমা স্যান্নাল জানান, চাতালটি তিন-চার মাস ধরে বন্ধ।

 

জানতে চাইলে মিল মালিক আনন্দ সাহা বলেন, ব্যবসায় ধসের কারণে মিল বন্ধ রয়েছে। মিল পরিচালনার দায়িত্ব অন্য একজনের ওপর দিয়েছিলাম। সে গুদামে চাল দিয়েছে।’ তবে তার নাম জানতে চাইলে ফোনটি কেটে দেন আনন্দ সাহা।

 

নড়াইল পৌর এলাকা হাটবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে সরকারি গুদামে তিন টন ধান দেয়ার তালিকাভুক্ত হই। মোবাইলে মেসেজ আসে, ১৫ জুনের মধ্যে ধান দিতে হবে। আমি ধান সংগ্রহ করতে থাকি। দুই দিন পর মেসেজ পাই, আমার ধান দেয়া হয়ে গেছে।

 

পরে আরেকটি মেসেজ পাই, আমার টাকাও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার নিজস্ব লোক আমার নামে গুদামে ধান দিয়েছেন। পরে তিনি টমাস নামে এক ছেলের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে আমাকে দেন।’

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাদুলীডাঙ্গা গ্রামের শ্রীমা রাইস মিলের এবার ৮০ দশমিক ৬৭০ টন চাল দেয়ার কথা। স্থানীয়রা জানান, এক বছর ধরে ওই মিল বন্ধ। মিলের মালিক অমরেন্দ্রনাথ দাশ অবশ্য বললেন, ‘গত এক মাস মিলটি বন্ধ থাকলেও সব চাল নিজের মিলে তৈরি করে গুদামে দেয়া হয়েছে।’

 

জেলা ধান-চাল ক্রয় ও গুদামজাতকৃত চালের মান যাচাই কমিটির সদস্য নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি তাজুল ইসলাম ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘কর্মকর্তারা অনিয়মের সুযোগ নিতে এবার আমাকে কোনো সভায় ডাকেননি। ধান সংগ্রহে কৃষকদের লটারিও স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়নি। শুনেছি খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা তার পছন্দের দুই-তিনজনকে নিয়ে ধান কিনিয়েছেন। এ ছাড়া একাধিক চুক্তিভিত্তিক মিল মালিক বাইরে থেকে চাল কিনে গুদামে দিচ্ছেন।’

 

বাংলাদেশ ক্ষেত মজুর ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বোরো ধান-চাল সংগ্রহে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য অনেক পুরোনো। নড়াইলের কয়েকজন মিলার কম দামে নিম্ন মানের চাল কিনে খাদ্যগুদামে দিচ্ছেন। কৃষকদের বাঁচাতে চিরস্থায়ীভাবে এসব দুর্নীতি বন্ধ করা প্রয়োজন।’

 

নড়াইল সদরের খাদ্য পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিষেক বিশ্বাস অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলতে পারেন। এগুলো আদৌ সত্য নয়। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’

 

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডু বলেন, ‘আমি এখানে যোগ দিয়েছি মাস দুয়েক হলো। এর আগেই চালকল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে। এ কারণে কোনো মিল অচল বা সচল, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া কৃষক ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে ধান কেনা ও টাকা তোলার সুযোগ নেই।’

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version