-->

লাখো মানুষ পানিবন্দি

মো. ইব্রাহিম শেখ, চট্টগ্রাম
লাখো মানুষ পানিবন্দি

মো. ইব্রাহিম শেখ, চট্টগ্রাম: ঘরে পানি। রান্নাঘরে চুলা জ্বালানোর সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। যারা কষ্ট করে আছেন, তারা দোকান থেকে কিনে খাচ্ছেন। সোমবার দুপুরে নগরের চকবাজার কাপাসগোলা মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেইনের বাসিন্দা আবদুল হামিদ ওই এলাকার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে এ কথা বলেন।

 

তিনি জানান, গতকালসহ টানা চার দিন পানিবন্দি হয়ে আছেন ওই এলাকার লোকজন। অবশ্য বিকেলে থেকে পানি নামতে শুরু করে সেখানে। শুধু মুহাম্মদ আলী শাহ লেইন না। পুরো নগরের নিম্নাঞ্চলগুলোর চিত্র একই। অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় আজসহ টানা ৫ দিন কার্যত পানিবন্দি ছিলেন তারা। এ সময় বিশুদ্ধ পানির সংকট তৈরি হয়। একইসঙ্গে ঘরে পানি ঢুকে যাওয়ায় ব্যাহত হয় রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজকর্ম।

 

এদিকে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।

 

আইএসপিআর জানায়, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি ও ভূমিধস মোকাবিলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় অবশ্য বৃষ্টি থামলে পানি নেমে যায়। বৃষ্টি শুরু হলে আবার পানি জমে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে দুর্ভোগে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন নগরবাসী। সরেজমিন পরিদর্শনে গতকাল দুপুরেও বহু সড়কে পানি দেখা গেছে। হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি ছিল এদিনও। কিছু এলাকায় সড়কে জমে যাওয়া পানিতে জাল দিয়ে মাছ ধরেন লোকজন। যাতায়াতে ব্যবহার করা হয় নৌকা। এছাড়া গতকাল নগরের দেড়শ’র অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। আজ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

 

খালে পানি নেই, তবু ডুবে আছে সড়ক: গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত ডুবেছিল মুরাদপুর সংলগ্ন মোহাম্মদপুর সড়ক। অথচ এ সময়ে সড়ক সংলগ্ন চশমা খালে পানির স্তর ছিল অনেক নিচে। শুধু গতকাল নয়, গত কয়েকদিন ধরে এ চিত্র ছিল সেখানে।

 

এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, মোহাম্মদপুর সড়কটির পানি ছোট্ট একটি নালা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পড়ে চশমা খালে। গত কয়েক বছর ধরে এ নালাটি পরিষ্কার করেনি কোনো সংস্থা। ফলে ভরাট হয়ে যায় নালাটি। তাই নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ডুবে যায় সড়ক।

 

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এ সড়কের মুখে চশমা খালের ওপর একটি কালভার্ট আছে। সে কালভার্ট পার হওয়া মাত্রই হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। গত তিন দিনে জলাবদ্ধতায় সড়কের দুইপাশের প্রায় প্রতিটি দোকানে ও বাসায় পানি ঢুকেছে। নষ্ট হয়েছে অনেক দোকানের মালামাল। বাসায় পানি ঢোকায় বসতিদের ভোগান্তি ছিল চরমে। অনেক বাসার নিচতলায় থাকা পানির মোটর নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভবনে পানি তুলতে না পারায় সংকট তৈরি হয় খাবার এবং ব্যবহারের পানির।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, চশমা খাল সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের আওতায় হলেও মোহাম্মদপুর সড়কের নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। দীর্ঘ কয়েক বছর নালাটি পরিষ্কার করেনি সংস্থাটি। তাই খালে পানি কম থাকলেও খাল থেকে উঁচু সড়কজুড়ে জলাবদ্ধতা হয়।

 

সড়কে মাছ ধরছেন লোকজন: পুরোনো চান্দগাঁও সিঅ্যান্ডবি এলাকায় গতকালও ডুবেছিল সড়ক। দুপুরে সেখানে হাতজাল দিয়ে স্থানীয়দের মাছ ধরতে দেখা গেছে। একই সময়ে বহাদ্দারহাট মৌলভী পুকুর পাড় এলাকায় একসঙ্গে পাঁচ-ছয়জনকে রাস্তায় জাল মেরে মাছ ধরার কথা জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। কয়েকটি এলাকায় ডুবে যাওয়া সড়কে জাল দিয়ে মাছ ধরার কথা জানান স্থানীয়রা।

 

সড়কে নৌকা: হালিশহর জেলা পুলিশ লেইন পানিতে ডুবে যায়। সেখানে যাতায়াতে ব্যবহার করা হয় নৌকা। শমসের পাড়া এলাকায়ও নৌকায় পানিবন্দি লোকজনের যাতায়াত করার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসার মাঠে এবং সামনের সড়কে হাঁটুর বেশি পানি দেখা গেছে। ওই এলাকার বেশিরভাগ বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগ ছিল স্থানীয়দের।

 

চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুন্নিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা হোস্টেল এবং আশপাশের এলাকায় ব্যাচেলর বাসায় থাকেন। ব্যাচেলর বাসায় পানি ঢুকে যাওয়ায় রান্না করতে পারেননি বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে পানির জন্য খাবারের দোকান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও ভোগান্তি হয়। দুপুরের দিকে প্রায় কোমরসমান পানি ছিল নগরের শান্তিবাগ আবাসিক এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা রাশেদ জানান, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এলাকার লোকজন।

 

চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সেনা মোতায়েন: চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় অনেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। একই সঙ্গে অনেক জায়গায় ভ‚মিধসের ঘটনাও ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে এ দুই জেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।

 

আইএসপিআর জানায়, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি ও ভূমিধস মোকাবিলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। টানা ৫ দিন ধরে প্রবল বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরের নিচু এলাকা এখনো পানির নিচে। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। জলাবদ্ধতার কারণে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগরের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আরো দুদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ৩০ বছরের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের নতুন রেকর্ড হয়েছে গত রবিবার।

 

এছাড়া চলতি মাসে যেখানে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ৫৩০.৬ মিলিমিটার সেখানে প্রথম ছয়দিনেই হয়েছে ৫৫০ মিলিমিটারের বেশি। অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পূর্ণিমার প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত তিনফুট উঁচু জোয়ার। টানা বর্ষণে একের পর এক ডুবেছে উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের রেলপথ ও সড়ক পথ। ডুবে গেছে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হাটহাজারী, রাউজানসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে ওইসব এলাকার লাখো মানুষ। এছাড়া একাধিক স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে।

 

এদিকে সোমবার দুপুরে অতিবৃষ্টিতে বান্দরবান সদরে পাহাড় ধসে একই পরিবারের মা-মেয়ে নিহত হয়েছেন। নিহতরা পৌরসভার কালাঘাটা গোধার পাড় এলাকার বাশি শীলের স্ত্রী ও মেয়ে বলে জানা গেছে। বৃষ্টিতে বান্দরবান-থানচি সড়কের ১২ মাইল এলাকায় পাহাড় ধসে সড়কে গাছ পড়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছে শহর থেকে রুমা-থানচি যোগাযোগ। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বান্দরবান সদর, রুমা, আলীকদমসহ জেলার বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে।

 

আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম গণমাধ্যমকে বলেন, মাতামুহুরী নদীর পানিতে চৈক্ষ্যং ইউপি পরিষদ এলাকার সড়ক প্লাবিত হয়ে আলীকদমে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

 

বান্দরবান সদর উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, বান্দরবান শহরের অর্ধেক অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। বান্দরবানের আশপাশের এলাকা; যেমন ক্যামলং, মাঘমারা, বালাঘাটা, ক্যচিংঘাটা, তংপ্র পাড়া, ধোপাছড়াসহ অনেক এলাকার জনসাধারণ এখন পানির দুর্ভোগের মধ্যে আছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশাসন থেকে ১৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

 

তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় মোট কতজন আশ্রয় নিয়েছেন তা জানা যায়নি। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ ৩৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বান্দরবানে। বৃষ্টিপাত এখনো অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে খাগড়াছড়ি ভারীবর্ষণের কারণে দীঘিনালার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ছয় শতাধিক মানুষ। জেলায় ১৩৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন জায়গায় ২ শতাধিক স্থানে পাহাড় ধস হয়েছে। এছাড়া লংগদু, নানিয়াচর, রাঙামাটি সদরের কুতুকছড়ি নিম্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। রাঙামাটি শহরের ৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ শতাধিক লোক আশ্রয় নিয়েছে।

 

রাঙামাটিতে ভারীবর্ষণে ৩৮১ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত: রাঙামাটিতে টানা সাত দিনের মাঝারি ও ভারীবর্ষণে পাহাড় ধসে ৩৮১ বসতঘর ধসে ক্ষতিগস্ত হয়েছে। এতে আহত হয়েছে ১০ জন। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সকালে ভারী বর্ষণে বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

 

জেলার আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৬৮.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪৬.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সকালে শহরের রিজার্ভমুখসহ কয়েকস্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে কোতোয়ালি থানা-পুলিশ ১৭ পরিবারের ৬০ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা করে।

 

রাঙামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, ‘টানা বর্ষণে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম, রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি বান্দরবান সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ৪৪টি স্থানে পাহাড় থেকে মাটি ধসে পড়ে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটি সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি।’

 

রাঙামাটি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় এ পর্যন্ত ২৩৫ স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। ৩৮১ বসতঘর ধসে গেছে। ২৪২টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ অবস্থান করছে। পাহাড় ধসে প্রাণহানি না হলেও আহত হয়েছেন ১০ জন।’

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version