টাঙ্গাইলের মধুপুর, ঘাটাইল ও সখীপুর উপজেলার রসালো ফল আনারসের জন্য প্রসিদ্ধ। ভরা মৌসুমে বাজার মন্দা থাকায় লোকসানে পড়ে কৃষকরা আনারস চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পরিমিত কেমিক্যাল ব্যবহারে চাষিদের প্রশিক্ষণের তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বর আনারসের ভরা মৌসুম।
আনারসের রাজধানী মধুপুর-ঘাটাইলে এ সময়ে আনারসকে ঘিরে কৃষক, পাইকার, মহাজন ও স্থানীয় পরিবহন শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এতদাঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল আনারস প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যাচ্ছে। চাষিরা আশায় বুক বাঁধলেও এবার ন্যায্য দাম পাচ্ছে না।
গত দশ বছরের মধ্যে এবার আনারসের বাজারে সবচেয়ে বেশি ধস নেমেছে। এ মন্দায় আনারস চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। মধুপুর কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের আবাদ হয়েছে। এ এলাকায় প্রতি হেক্টর জমিতে আনারসের গড় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হেক্টর প্রতি ৩৮-৪০ টন।
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে- দুই লাখ ৭৩ হাজার ৬০০ টন। গত বছরের চেয়ে এবার আনারসের চাষ বেশি হয়েছে। এতদাঞ্চলে ইতোপূর্বে জায়ান্টকিউ বা ক্যালেন্ডার, হানিকুইন বা জলডুগী এ দুই জাতের আনারসের চাষ হতো। এবার থেকে বিশ্ব খ্যাত ফিলিপাইনের সুপার সুইট এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হচ্ছে। বাজার মন্দা থাকায় এবার লোকসানে হতাশায় দিন গুনছে কৃষক।
ব্যাংক লোন, সারের দোকান বাকি ও শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে মধুপুরের জলছত্র, মোটের বাজার, ইদিলপুর, পিরোজপুর, দোখলা, সানিয়ামারি ও আউশনারা, ঘাটাইল উপজেলার সাগরদীঘি, গারোবাজার, পাকুটিয়া এবং সখীপুর উপজেলার কচুয়া, বড় চওনা বাজারে গিয়ে কৃষক, পাইকার, ফড়িয়া ও মহাজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিগত বছরের চেয়ে এ বছর বাণিজ্যিক চাষ বেশি হওয়ায় আনারসের বাজার মন্দা।
বাণিজ্যিক চাষের ফলে অতি মুনাফালোভীদের থাবায় রসালো ফল আনারস ঐতিহ্য হারাচ্ছে। অপরিপক্ব গাছে অসময়ে আনারস বের করার জন্য বাণিজ্যিক চাষিরা অসাধু পন্থায় কেমিক্যাল প্রয়োগ করছে। মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগের ফলে গাছ ও ফলের রাতারাতি ফলনের অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে বাণিজ্যিক চাষিরা। বড় ফল উৎপাদন করে বাজার দখল করার মানসিকতার কারণে এতদাঞ্চলের আনারসের আদি আকার হারিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি, বাড়তি শ্রমিক মজুরি, সার ও কেমিক্যালের অতিরিক্ত খরচ, পাইকারদের মোকামে চাহিদা কম এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যসহ নানা কারণে আনারসের চাহিদা ভোক্তা পর্যায়ে দিন দিন কমে যাওয়ায় এ বছর বাজার মন্দা যাচ্ছে- স্থানীয়রা এমনটাই ধারণা করছে।
ঘাটাইলের গারোবাজারের কৃষক আজাদুর রহমান জানান, গেল বছর যে আনারস ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি করেছেন, চাহিদা কম থাকায় এ বছর পাইকাররা ৩০-৩৫ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে চাচ্ছে না।
কুষ্টিয়ার আড়ৎদার শাহজাহান আলী জানান, এবার আনারসের চাহিদা কম। অন্যান্য বছর সকালে ট্রাক থেকে আনারস আড়তে নামালে খদ্দের ভিড় জমাত। এখন ভিড় ও দাম দুটোই কম। প্রতিপিস ৬০-৭০ টাকার টাকার আনারস বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা।
আনারস চাষি সোহেল রানা জানান, আনারস বড় ও পাকাতে বিভিন্ন কোম্পানির রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গ্রোথ হরমোন ব্যবহারে আনারসের আকার বড় হলেও ভেতরে ফাঁপা ও পানসে হয়ে যায়। অধিক লাভের জন্য বড় করার আশায় প্রশিক্ষণহীন কৃষকরা মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করার ফলে এমন অবস্থা হয়ে থাকে।
বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক ছানোয়ার হোসেন জানান, চাষিদের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি হলেই নিরাপদ আনারস চাষ করা সম্ভব।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে এমডি-২ জাতের আনারসের চারা কৃষি বিভাগ আমদানি করে। পরে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মধুপুরের কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ১০৭ জন কৃষককে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ চারা দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১২০ জন কৃষককে ২ লাখ ৭০ হাজার চারা দেয়া হয়। মধুপুরের মাটি আনারস চাষের উপযোগী ও প্রতিবছর প্রচুর আনারস উৎপাদিত হয়।
কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে অনেক আনারস নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বিদেশের বাজার ধরার জন্য নতুন জাতের এমডি-২ আনারস চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই জাতের আনারস পাকার পর প্রাকৃতিকভাবেই এক মাস সংরক্ষণ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে যে চারা বিতরণ করা হয়েছিল- সে ফল এখন বাজারে আসতে শুরু করেছে।
কৃষকরা জানায়, নতুন জাতের এই আনারস নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক শঙ্কা ছিল। কিন্তু সেই শঙ্কা এখন আর নেই। মধুপুরের অনেকেই এই জাতের আনারস চাষের পরিকল্পনা করছেন। আনারসের পাইকারি হাট গারোবাজারে গিয়ে দেখা যায়, এমডি-২ জাতের আনারস চাষিদের অনেকেই বাজারে এনেছেন। পাইকাররা কেটে খেয়ে স্বাদ পরীক্ষা করে আনারস কিনছেন।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, এ বছর মধুপুরে ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। নিরাপদ আনারস চাষের ওপর কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার জানান, মধুপুর গড়ের আনারসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে চাষি, পাইকারসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য