-->
শিরোনাম
ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম

ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে চলে হাজারো মানুষের জীবন

এসএলটি তুহিন, বরিশাল
ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে চলে হাজারো মানুষের জীবন
পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদে ক্রিকেট ব্যাট তৈরিতে ব্যস্ত কারিগর

অজপাড়াগাঁয়ের একটি গ্রামের নাম বিন্না। গ্রামটিকে এখন সবাই চেনে ‘ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম’ হিসেবে। পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের অবহেলিত এ জনপদ বিন্না। আধুনিকতার কোনো ছাপ পড়েনি এখনো এ জনপদে। তবুও বসে নেই এখানের সংগ্রামী নারী-পুরুষ। আধুনিক সভ্যতার ছোয়া তেমন না লাগলেও এ গ্রামকে অনেকেই চেনেন ‘ব্যাট কালামের’ গ্রাম হিসেবেও। আর ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে হাজারো মানুষের।

 

দীর্ঘযুগ ধরেই কাঠ ব্যবসায় সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে ব্যাপক পরিচিত জেলার নেছারাবাদের ইন্দেরহাট এবং বিন্না, জিলবাড়ি, চামি, ডুবি, উড়িবুনিয়া, পঞ্চবটি ও বলদিয়াসহ অন্তত আরো ১৫টি গ্রাম। আর এসব নিভৃত গ্রামেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্রিকেট ব্যাট তৈরির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানা। বর্তমানে কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিকেরও বেশি।

 

ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অন্তত আড়াই তেকে তিন হাজার মানুষ। প্রতিদিন এসব গ্রাম থেকে শত শত ব্যাট তৈরি করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্রীড়া সরঞ্জামাদির দোকানে। দেশের শতকরা ৭০ ভাগ তৈরি ব্যাটের চাহিদা পূরণ হয় নেছারাবাদ অঞ্চল থেকে, এমন কথা শুনিয়েছেন এখানকার ব্যাট তৈরির কারিগররা। দেশে যে হাজার হাজার দেশীয় ব্যাটের ব্যবহার হয় তার জনক হচ্ছেন নেছারাবাদের বেলুয়া নদের তীরে অবস্থিত উড়িবুনিয়ার অখ্যাত ছুতোর পরিবারে জন্ম নেয়া মৃত আব্দুল লতিফ মিয়া।

 

তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে কাঠ মিস্ত্রি হিসেবে জুরাইনের ‘খেলার সাথী’ নামের একটি কাঠের কারখানায় কাজ পান। সেখান থেকেই বিভিন্ন খেলার সামগ্রী যেমন প্রাইজ শিল্ড, ক্রিকেট ব্যাট, ক্যারামবোর্ড ও হকিস্টিক মেরামতের কাজ রপ্ত করেন। এরপর থেকেই লতিফের মাথায় চেপে বসে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির নেশা।

 

বিদেশি ব্যাট তৈরির সমমানের স্থানীয় গাছের সন্ধান করতে থাকেন তিনি। খুঁজে বের করেন দেবদারু, কদম ও বাইনসহ নানা প্রজাতির কাঠ। আর এসব কাঠ দিয়ে শুরু করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ। সস্তায় ব্যাট তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন নিজ গ্রাম বিন্নায়। তার পর নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন ব্যাট তৈরির ক্ষুদ্র কারখান। ঢাকার বাইরে নেছারাবাদে এটাই ব্যাট তৈরির আদি কারখানা।

 

লতিফ মিয়ার কারখানাকে ভিত্তি করে ঢাকায় আমদানিকৃত ক্রিকেট ব্যাটের পাশাপাশি দোকানে স্থান পায় নেছারাবাদের ক্রিকেট ব্যাট। এভাবেই নিজ গ্রাম থেকেই রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধি পেতে থাকায় তার দেখাদেখি বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠে ব্যাটের কারখানা। লতিফের সহকর্মী কালাম নিজ বাড়িতে বিশাল কারখানা তৈরি করায় এর সৌরভ ছড়িয়ে পরে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে।

 

ব্যাট তৈরির কারিগর আবুল কালামের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছিলেন স্বামীর ক্রিকেট কারখানার অন্যতম মালিক হিসেবে। কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে নিলুফা যোগ দেন নোবেল বিজয়ী ড. মো. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে। পদক্ষেপ নামের একটি এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণ গ্রুপের সফল শিল্প উদ্যোক্তা নিলুফ ইয়াসমিন।

 

ওই বছরই নিলুফা ঢাকায় সিটি গ্রুপ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পুরস্কার পান। কানাডার সম্মেলন থেকে অন্যান্য পুরস্কার ছাড়াও নিলুফাকে ৪ হাজার মার্কিন ডলার নগদ অর্থ উপহার হিসেবে দেয়া হয়। বাংলাদেশি ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা সমমানের এ উপহারের অর্থ দিয়ে কালাম-নিলুফা দম্পত্তি জমি কিনে বাড়ি ও ব্যাট কারখানা গড়ে তুলেন। এদিকে, বিগত কয়েক বছর আগে থেকেই নিজ গ্রাম থেকে স্থাানীয় বিভিন্ন হাট-বাজারে ব্যাট বেচাকেনা শুরু হয়।

 

ব্যাটের কারিগররা জানান, প্রাথমিকভাবে গাছ চেরাই করে ব্যাট উৎপাদন করলেও সেগুলোকে পরবর্তীতে ঢাকায় প্রেরণ করা হতো এবং সেখানেই ঘষামাজা, বার্নিস এবং লেবেল লাগিয়ে বিক্রয় করা হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই কাজ গ্রামে বসেই করছে আর এক পর্যায়ের ব্যাট ব্যাবসায়ীরা। পরে সেই ব্যাটগুলোকেই ঢাকাসহ পিরোজপুর, বরিশাল ও খুলনায় বিক্রয়ের জন্য পাঠানো হচ্ছে।

 

উৎপাদনকারী স্থানীয় ব্যাট কারিগররা জানান, প্রকারভেদে বিভিন্ন গাছের ব্যাট বার্নিস, রঙ, লেবেল ও হাতলে প্লাস্টিকজাতীয় এক ধরনের টেপ লাগিয়ে বিক্রয় করা হয় প্রকারভেদে ১৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়।

 

অন্যদিকে, ঘষামাজা ও লেবেল লাগান প্রতিটি ব্যাট পাইকারি রেটে ঢাকায় বিক্রয় করা হয় ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং ৮৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত।

 

পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদের ব্যাট শিল্প এবং অত্র শিল্পের কারিগরদের নিজ পেশায় টিকিয়ে রাখতে হলে এ খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কাঁচা মালের মূল্য কমানোসহ যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়ন হলে পেশার মান উন্নত ও ব্যাবসায়ীরা আরো লাভের মুখ দেখতে পেতেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version