দিনাজপুর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে যেতে হয় গহীন গ্রামে ভাবির মোড় নামক এলাকায়। সুস্বাদু হাঁসের মাংসের জন্য বিখ্যাত দিনাজপুর বোচাগঞ্জ রানীর ঘাট ভাবির মোড় নামক এলাকাটি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দল বেঁধে মাইক্রো, বাস, মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে আসছেন খাদ্যপ্রেমীরা। ‘ভাবির মোড়’-এর হাঁসের মাংসের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
সেখানে রানীর ঘাট টাঙ্গন নদীর ওপর অবস্থিত ব্রিজ রাবার ড্যাম দর্শনার্থীদের জন্য একটি পর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে। নদীর রাবার ড্যামের পাশেই সারিবদ্ধভাবে চোখে পড়ছে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। পাশেই রয়েছে ভারতের কাঁটা তারের সীমান্ত বেড়া। নদীর ধার দিয়ে আদিম যুগের ন্যায় সেই পুরোনো তাল গাছ। নদীর স্রোতের টানে মানুষের মন জুড়িয়ে যা”েছ। এ যেন এক অসাধারণ অনুভূতি, অপরূপ দৃশ্য।
নদীটির একপারে দিনাজপুর বোচাগঞ্জ উপজেলার রানীর ঘাট, অন্যপারে ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জ উপজেলার বৈইরচুনা রানীর ঘাট। আর এই ব্রিজটি সংযোগ স্থাপন করেছে বৃহত্তর দিনাজপুরকে। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা ভাবির মোড়। ওই এলাকার প্রকৃত নাম রানীর ঘাট। পাশেই টাঙ্গন নদী ও রাবার ড্যাম। নদী পার হলেই ঠাঁকুরগাওয়ের পীরগঞ্জ সীমান্ত। তবে রানীর ঘাট এখন লোকমুখে পরিচিতি পেয়েছে ভাবির মোড় নামে।
এখানে কয়েকজন নারী হোটেল করে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ব্যবসা করেন। স্থানীয় লোকজন তাদের ভাবি বলেই সম্বোধন করে থাকেন। ভাবিদের হাতে তৈরি মজাদার হাঁসের মাংসের রান্নার খবর বিভিন্নভাবে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। লোকমুখে রানীর ঘাট পরিচিতি পায় ভাবির মোড় নামে।
দিনাজপুরের ভাবির মোড় বর্তমানে এতটাই প্রসিদ্ধ যে, এখানে প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক হাঁস রান্না করা হয়। মাসে যা ৬ হাজারের বেশি। এতে মাসে এসব দোকানের গড় বিক্রি ৭০ লাখ টাকা হয়।
রানীর ঘাট তথা ভাবির মোড়ে প্রথম দিকে দুই থেকে তিনটি হোটেল থাকলেও বর্তমানে এখানে ৭ জন ভাবি ৭টি হোটেল করেন। কুলসুমা, তাসলিমা, মাসতারা, মেরিনা ছাড়াও এখানে রাজিয়া, বেলি, লিপি নামে ৭ জন নারী হোটেল দিয়েছেন। যারা লোকমুখে ভাবি বলেই সমাদৃত। এই নারীরা যেমন পাল্টে দিয়েছেন জায়গার নাম, তেমনি পরিবর্তন করেছেন নিজেদের ভাগ্যও। অনেকেই তাদের দেখে হচ্ছেন অনুপ্রাণিত।
ভাবির মোড়ের অন্যতম ব্যবসায়ী কুলসুমা বলেন, আমার স্বামী বিদেশে থাকত। দেশে ফিরে এসে কৃষিকাজ করত। আমরা হোটেল দেয়ার পর এখন প্রায় ১৫ জন মানুষ আমাদের এখানে কাজ করে, তাদের সংসার চালায়। তারাও এখন আমাদের মতো সুখী। কিন্তু প্রথম দিকে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। স্বামী জিয়াউর রহমান বিদেশে থাকাকালীন সময় এখানে চা, বিস্কুট বিক্রি করতাম।
তারপর ভাত, তরকারি, ডিম, টাঙ্গন নদীর মাছ, দেশি মুরগির মাংস। ক্রেতাদের অনুরোধে দুই-চারটা করে হাঁস রান্না করতে লাগলাম। এখন বর্তমানে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০টা হাঁসের মাংস বিক্রি হয়। যা থেকে দৈনিক ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি।
ভাবির মোড়ে বন্ধুদের নিয়ে জয়পুরহাট থেকে খেতে আসা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভাবির মোড়ের কথা শুনে অনেক দিন থেকেই আসার পরিকল্পনা করছিলাম। এখন বন্ধুদের নিয়ে এসেছি। সকাল থেকে ভাবিদের মাংস কাটা, রান্না করা দেখেছি। রান্না খেয়ে অনেক ভালো লাগল। শহরের তুলনায় দামও অনেক কম। এখানকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশন একদম ঘরোয়া। পাশেই নদী ও রাবার ড্যাম আছে। সব মিলিয়ে অনেক ভালো লাগল।
ভাবিদের দেয়া তথ্যমতে, ৭টি হোটেলে দৈনিক গড়ে ২ শতাধিক হাঁসের মাংস রান্না করা হয়। প্রতি জোড়া হাঁস তারা ক্রয় করেন ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি মাসে তাদের প্রায় ৬০০০ থেকে ৭০০০টি হাঁস রান্না করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৬ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা। তাদের দৈনিক গড় বিক্রি প্রায় ২ লাখ টাকারও বেশি। আর প্রতি মাসে তাদের বিক্রি হয় প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকা।
প্রতিদিন দিনাজপুর ছাড়াও আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে খাদ্যপ্রেমীরা ভাবির হোটেলে আসেন হাঁসের মাংসের স্বাদ উপভোগ করতে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য