-->
শিরোনাম

৬ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে ৩ লাখ শিশু

এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার
৬ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে ৩ লাখ শিশু
কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিত্র

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দৈনিক জন্ম নিচ্ছে ১২০-১৩০ শিশু। এরই মধ্যে গত ছয় বছরে জন্ম নিয়েছে প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার শিশু। ক্যাম্পে দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, রেশন বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্যাম্প জীবনে অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত না থাকায় এবং অল্প বয়সে বিয়ে ও একাধিক বিয়েতে বিনা বাধায় আবদ্ধ হওয়ায় রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বাধিক।

 

একদিকে রোহিঙ্গাদের ঊর্ধ্বমুখী জন্মহার অন্যদিকে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে সংযুক্ত হওয়া আর একের পর এক বনভ‚মি ধ্বংস হওয়াতে চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছেন স্থানীয়রা। ফলে রোহিঙ্গা সংকট দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তবে ঊর্ধ্বমুখী জন্মহার নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা ছিল বেশি। যেসব রোহিঙ্গা শিশু ৮-১০ বয়সে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা বর্তমানে ২-৩ সন্তানের বাবা বা মা হয়েছেন। এর আগে ’৯০-এর দশকেও অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সবমিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছে ১৫ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা।

 

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট পরিবার রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ জনের বেশি। ২০ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ থেকে ৯ জন। ২৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয় থেকে সাতজন। ২৮ শতাংশ পরিবারে সদস্য সংখ্যা ২ থেকে তিনজন।

 

গড়ে প্রতি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮। আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর বেশিরভাগ উখিয়ার কুতুপালংয়ে। যেটিকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ আশ্রয়শিবির। সেখানে ছোট একটি এলাকার মধ্যে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস।

 

বালুখালী ৯নং ক্যাম্পের নুর আহমদ বলেন, ৭ জন সন্তানের মধ্যে ৪ জন ছেলে ও ৩ জন মেয়ে। এখন যদি সামনে আল্লাহ আরো দেয় তাহলে সন্তান আরো নেব। শুধু নুর আহমদ নন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে বেশির ভাগের সন্তান সংখ্যা ৭-৮ জনের বেশি। এমনকি যাদের পরিবারে ৫ থেকে ৬ জনের বেশি সন্তান রয়েছে তারা আরো সন্তান নিতে আগ্রহী।

 

ক্যাম্পে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে অনাগ্রহ, রেশন বৃদ্ধি ও ক্যাম্প জীবনে তেমন কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বেশি সন্তান জন্মদানের মূল কারণ।উখিয়ার কুতুপালংয়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মিডওয়াইফ সুপারভাইজার আসমা আকতার বলেন, আরটিএমআই ইউএনএফপিএর অধীনে পরিচালিত প্রজেক্টে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঠ পর্যায়ে কাজ করি।

 

রোহিঙ্গারা দীর্ঘমেয়াদি যে পদ্ধতি রয়েছে এটা নিতে একদম আগ্রহ নেই। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্ত্রী-স্বামী ও শাশুড়িকে এনে কাউন্সেলিং করি। রোহিঙ্গারা পিল, কনডম ও ডিপুগুলো নিতে চায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ৩, ৫ বা ১০ বছরের যে পদ্ধতিগুলো একদম নিতে চায় না। কারণ রোহিঙ্গারা মনে করে, সন্তান যত বেশি জন্ম নেবে মাথাপিছু রেশন তত বেশি হবে। এ জন্য রোহিঙ্গারা জন্মদানে বেশি আগ্রহী। এ ছাড়াও তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার কাজ করে। অনেকে মনে করেন তাদের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেলে নিজ দেশ তথা মিয়ানমার জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে।

 

একই ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা. ফাতেমা আকতার বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা অনেক বেশি। আমরা ক্যাম্পে প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকি। আমরা বেশি জোর লাগাচ্ছি, কাজ করছি মাঠ পর্যায়েও। আমরা মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি পরিবারের কাছে গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে বুঝাচ্ছি এবং ডেমো প্রদর্শন করছি।

 

এদিকে, কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৬ লাখের মতো। এখন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বেশি, যা নতুন করে ভয়াবহ সংকট হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, যেভাবে রোহিঙ্গারা একসাথে এসেছিল, একই রকম করে এ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

তা না হলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রোহিঙ্গা এখান থেকে যাচ্ছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যেসব শিশু বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে তাদের তালিকা নেয়নি মিয়ানমার সরকার। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ইমামদের সম্পৃক্ত করে সচেতনতার কাজ করে যাচ্ছি। প্রতি বছর আশ্রয়শিবিরে যে হারে বাড়ছে জনসংখ্যা অন্যদিকে কমছে খাদ্যসহায়তা।

 

সবমিলিয়ে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে নানামুখী সংকট যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version