নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে স্বেচ্ছায় নীল চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন রংপুরের কৃষকরা। কৃষি বিভাগ সূত্র থেকে জানা যায়, রংপুর জেলার তারাগঞ্জ, গংগাচড়া, ও নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২৬ হেক্টর জমিতে কৃষকরা নীল চাষ করছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। চার থেকে পাঁচ বছর আগেও নীল চাষ হতো ১০০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু মাঝে নীল উৎপাদনকারী কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় এর আবাদ কমে যায়। বর্তমানে বন্ধ কারখানাগুলো আবার চালু হওয়ায় নতুন করে নীল চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন কৃষকরা।
মঙ্গলবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে তারাগঞ্জ উপজেলা থেকে ৭ কিলোমিটার এবং গংগাচড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী হরকুলি ঠাকুরপাড়া গ্রামে ২২ শতাংশ জমিতে কারখানাটি তৈরি করেছেন নিখিল রায়। সড়কের দুই ধারে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নীলখেত। নিখিল রায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং নীলের বীজ দিয়েও তাদের সহায়তা করছেন।
নিখিলের নীল তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের ২৫-২৬ জন নারী সেখানে নীল তৈরিতে ব্যস্ত। কথা হলে ঠাকুরটারী গ্রামের ললিতা রানী বলেন, নিখিল দাদার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের জমিতে নীল চাষ করছি। পাশাপাশি আনুষঙ্গিক কাজ করি। এতে আমার সংসার ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে। একইভাবে ওই কারখানায় কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
হরকলি এলাকার ময়না বেগম, দুলালী, নিশিতা রায়, গোপাল রায়, প্রভারানী সাবিত্রী বালাসহ অনেক কারখানার শ্রমিকরা জানান, তাদের প্রতি দিনের মজুরি ২৫০ টাকা। মাসে কয়েক দিন ছুটি কাটালেও তাদের প্রায় ৬ হাজার টাকা আয় হয়।
ঠাকুরপাড়া গ্রামে কৃষক হরি রায় জানান, ১ একর জমিতে তিনি নীলগাছের চাষ করেছেন। ৩ দফায় নীল পাতা বিক্রি করেছেন ১৩,৩০০ টাকায়। জ্বালানি হিসেবে মালগাছ বিক্রি করেছেন ৫,৮০০ টাকার। আবার যে গাছ আছে তা বিক্রি করতে পারবেন আরো ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়। ১ একর জমিতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ২,১০০ টাকা।
তার মতে, নীল চাষের সুবিধা হলো খরচ ও ঝামেলা কম। গরু-ছাগল খায় না। কারখানায় ফেলে দেয়া ডাটা অন্য ফসল চাষের জন্য জমিতে প্রাকৃতিক সার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এতে সার কম লাগছে, ফলন বাম্পার হচ্ছে। জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য ১ বছর পর পর নীল চাষ করেন। এতে উঁচু জমিতে রবিশস্য আবাদে সার কম লাগে।
তারাগঞ্জের বালাবাড়ি গ্রামের কৃষক জ্যেতিষ রায় জানান, তার চাষের প্রধান ফসল ধান। বছরে ২ বার ধান চাষ করেন এবং তিনি এক ফসল বিক্রি করে আরেক ফসলের খরচ যোগান। ইরি-বোরোয় লাভ হলেও বন্যায় পোকামাকড়, অনাবৃষ্টির কারণে প্রতি বছর আমন খেত নষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে যেত। খরচ বাদে খুব সামান্যই লাভ থাকত। কোনো বছর খেতের খড়ই আসতে পারত না, উঠতো না আবাদের খরচ। তবে সেই দিন শেষ হয়ে গেছে তার।
তিনি আরো জানান, নীল চাষে কোনো সার বা বাড়তি খরচের প্রয়োজন হয় না। প্রতি একর জমির নীলগাছ থেকে প্রায় ৩ হাজার কেজি পাতা পাওয়া যায়। নিখিলের কারখানায় প্রতি কেজি পাতা ৪ টাকা দরে কেনা হয়। এ হিসাবে ১ একর জমির নীলগাছের পাতার দাম দাঁড়ায় ১২ হাজার টাকা। প্রতি একর জমির শুকানো নীলগাছ জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হয় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায়।
নিখিল রায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রংপুরের গঙ্গাচড়ার উপজেলার হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে নিখিলের জন্ম। তার বাবার নাম অনিল কুমার রায়। ২০০৬ সালে তিনি এমসিসি বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থায় নীল তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নেন। পরে সংস্থাটির আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় শুরু করেন পাতা থেকে নীল তৈরির কাজ। পোশাক কারখানায় নীলের চাহিদা রয়েছে। সুতা ও কাপড়ে রং করতে এটি ব্যবহৃত হয়।
নিখিল বলেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখি, প্রায় প্রতি পরিবারেই অভাব-অনটন। বছরের বেশির ভাগ সময় গ্রামটির লোকজন বেকার থাকেন। এ কারণে তাদের দিন কাটে না খেয়ে। লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি তখনই আমার মাথায় আসে।
তিনি জানান, কারখানার তালিকাভুক্ত চাষি ৭২০ জন। তারা প্রায় ২৫০ একর জমিতে নীলের চাষ করেন। আরো প্রায় ৩৯০ জন সাধারণ চাষি আছেন। তারা ১২৫ একর জমিতে নীলগাছের চাষ করেন।
নীল তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে নীলগাছের পাতা সংগ্রহ করে আঁটি বেঁধে পানি দিয়ে ড্রামে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। পানি হালকা সবুজ হলে তা অন্য একটি ড্রামে নিতে হয়। ৩০ মিনিট ঝাঁকুনির পর ড্রামের পানিতে প্রচুর ফেনা হয়। এরপর ড্রামের মুখে মার্কিন কাপড় (পাতলা সুতি কাপড়) দিয়ে ছাঁকলে এক ধরনের আস্তরণ (তলানি) পড়ে। এগুলো সংগ্রহ করে দু-তিন দিন রোদে শুকালে কঠিন হয়ে যায়। ওই কঠিন আস্তরণ গুঁড়ো করলে তৈরি হয় নীল।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, ব্রিটিশ আমলে রংপুর অঞ্চলের চাষিরা নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীল চাষ বন্ধের জন্য আন্দোলন করেন। এখন নিখিলের বদৌলতে নীল চাষ করে লাভবান রংপুরের অনেক চাষি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য