নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদী গণেশ্বরী। নদী নয় যেন মরা খালে পরিণত হয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা পাহাড়ি এই নদী। নদীর বুকে বালু জমে চর জেগে উঠেছে। মানুষ হেঁটে পার হচ্ছে ওই নদী। বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তবর্তী নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের গ্রাম ফুলবাড়ি।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ সাত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয় ওই গ্রামে। সাত শহীদের কবরস্থান ঘেঁষে ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপত্তি হয় গণেশ্বরী নদীর। এক সময় ওই নদী ছিল খুবই খরস্রোতা। সময়ের পরিবর্তনে এক সময়ের খরস্রোতা নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে।
নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি নদীগুলোর বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। লেঙ্গুরা ইউনিয়নের রংরা থেকে শুরু হয়ে গণেশ্বরী নদী কলমাকান্দাউপজেলার বাখলা নদী হয়ে উদ্ধাখালীতে গিয়ে মিশেছে। বর্ষাকালে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ওই সমস্ত নদীতে পানি প্রবাহ দেখা যায়। এছাড়া সারা বছর নদীগুলোতে পানি প্রবাহ থাকে না।
নদীগুলোর প্রশস্ততা বিভিন্ন স্থানে ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এছাড়া পাহাড়ি নদী উদ্ধাখালী, মঙ্গলেশ্বরী, মহাদেওসহ বিভিন্ন নদীর অবস্থা খুবই খারাপ। সারা বছর ওই সমস্ত নদীতে পানি প্রবাহ থাকে না। স্থানীয় হতদরিদ্র নারী-পুরুষ নদীতে নেমে বালি, কয়লা ও নুড়ি পাথর সংগ্রহ করে।
এলাকাবাসী জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সঙ্গে বালি এসে নদীর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এক সময় সীমান্তবর্তী নদীগুলো দিয়ে চলত বড় বড় পাল তোলা নৌকা, ইঞ্জিনচালিত লঞ্চ। নদীতে পাওয়া যেত মহাশোল মাছ ও দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণি। সময়ের পরিবর্তনে এখন আর চলে না ওই সমস্ত নৌকা। নদীর বিভিন্ন স্থান দখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দেখা যায় না মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণি।
সরকারিভাবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এতে নদী নাব্যতা হারাচ্ছে। নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দার পাহাড়ি নদী গনেশ্বরী, উদ্ধাখলী নদীর তীরবর্তী ফুলবাড়ি, রগুনাথপুর, ছত্রংপুর, লেঙ্গুরাসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে পানি প্রবাহ নেই। নদীর বুকে বিভিন্ন স্থানে চর জেগে উঠেছে। নারী-পুরুষ বালি, নুড়ি পাথর উত্তোলন করছে। নদীতীরে বিভিন্ন জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে বালি ও নুড়ি পাথর।
কথা হয় কলমাকান্দার লেঙ্গুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রত্যয় জাম্বিল ও সাজিদা আক্তার খাতুনসহ বেশ কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে। প্রত্যয় জাম্বিল বলেন, ৯০ দশকেও গণেশ্বরী নদী দিয়ে চলত বড় বড় পাল তোলা নৌকা। নৌকায় করে মানুষ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করত। নদীতে এখন আর নৌকা চলে না। নদী ভরাট হয়ে গেছে। উজার থেকে নেমে আসা বালি ও নূরী পাথরে নদীর তলদেশ ভরে গেছে।
কলমাকান্দা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সুকুমার চন্দ্র বনিক বলেন, আমাদের এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। পাহাড়ি নদীগুলোতে সারা বছর পানি থাকত। নদীতে থাকত মাছ- জলজ প্রাণি। এখন আর নেই সে সবের কিছুই। নদীরমুখ বন্ধ হয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়ছে।
কলমাকান্দা উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম খসরু বলেন, নদী আর এখন নদীর জায়গায় নেই। নদীর বুকে বালি জমে চর জেগে উঠেছে। বর্ষা মওসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিছুটা পানির প্রবাহ দেখা দেয়া হয়। শুধু গণেশ্বরীই নয় মহাদেও, উদ্ধাখালীসহ সব কটি নদী ভরাট হয়ে গেছে। এক সময় ওইসব দী দিয়ে পাল তোলা নৌকা চলত।
লেঙ্গুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ভূইয়া বলেন, আমাদের এলাকার নদীগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বিশেষ করে গণেশ্বরী নদী। ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টি হলেই নদী পানিতে ভরে যায়। সামান্য বৃষ্টিতেই নদীতে বন্য দেকা দেয়। দুই তীর উপচে নদী তীরবর্তী গ্রামে পানি প্রবেশ করে। মানুষের দুর্ভোগ দেকা দেয়।
রগুনাথপুর গ্রামের মো. তাজউদ্দিন ইসলাম বলেন, গণেশ্বরী নদীর অনেকটা জায়গা ভারতের মধ্যে আছে। আমরা গরিব মানুষ নদী থেকে পাথর তুলে বিক্রি করি। আমাদেরও কেউ কিছু বলে না। সারা দিন যা পাই তা বিক্রি করে আমার সংসার চলে।
বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান বলেন, নেত্রকোনার এক সময়ের খরস্রোতা নদ- নদীগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। নদীর বুকে পলি জমে নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পাহাড়ি নদ গণেশ্বরী, উদ্ধাখালি, মহাদেও, সোমেশ্বরী নদীতে বালি জমে পানি প্রবাহ প্রায় বন্ধ। নদীগুলো খনন করা না হলে এক সময় নদী তীরবর্তী ফসলী জমি হুমকির মূখে পড়বে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নেত্রকোনার নেটওয়ার্ক মেম্বার দিলওয়ার খান বলেন, নদী সুরক্ষায় আমরা কাজ করছি। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের নদীগুলো খননের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য