নদী ভাঙনের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে তিস্তা পাড়ের মানুষের। ভাঙন শুরু হলে বুক ধরফর শুরু হয় কখন জানি কলিজাটা ফুটা করে এই রাক্ষুসী তিস্তা নদী। তিস্তা নদীতে কখনো ধু ধু বালি আবার কখনো টইটুম্বুর পানিতে ভরা যৌবন। অতি বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আশা পাহাড়ি ঢল নদীভাঙনের একমাত্র কারণ। ফলে আবাদি ফসলের ক্ষতিসহ বাপ-দাদার একরের পর একর জমি হারিয়েছেন তিস্তার পাড়ের মানুষ। নদীভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তা পাড়ের মানুষদের।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও তিস্তার পাড়ের মানুষের দুর্ভোগের কোনো সমাধান হয়নি। তাই সমাজের সচেতন মহল ও তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া এই দুর্ভোগ কখনোই লাঘব হবে না।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রংপুরের কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়ার উপজেলার তিস্তার তীরবর্তী গ্রামের বাসিন্দাদের বসতভিটা ও ফসলি জমিসহ গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে পড়েছে। কাউনিয়া উপজেলার গনাই, পাঞ্চর ডাঙ্গা, ঢুষমারা, আরাজি হরিশ্বর, চর গণাই, তালুক শাহবাজ, হযরত খাঁ, হরিচরণ শর্মা গ্রামের শতাধিক পরিবারের বসতবাড়িসহ কয়েকশ বিঘা ফসলি জমি, বাঁশ ঝাড়, গাছপালা, গরু মহিষের গোয়ালঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। নদীভাঙনের উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে এসব নদীভাঙন মানুষের।
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই গ্রামের কৃষক বদিউর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ’সাংবাদিকেরা ল্যাখেন হামার কই কাম হয়। নদী তো প্রতিদিন ভাঙতে আছে ঘুম হয় না আতঙ্কে, কেউ ঘর-বাড়ি নিয়া কোনটে যাইবে সে চিন্তায় আছে।’
তবে নদী পাড়ের মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ গাছ কাটছেন। প্রতি রাতেই নদীভাঙনের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে তাদের। গঙ্গাচড়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা নদী। এই ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সদর ইউনিয়নের গান্নারপাড় ও ল²ীটারি ইউনিয়নের শংকরদহ গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। আগে শংকরদহ গ্রামে ৫০০ থেকে ৬০০ পরিবার বসবাস করতেন, কিন্তু নদীভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে এলাকা ছেড়েছেন অনেক পরিবার। বর্তমানে সেখানে রয়েছে ২০ থেকে ২৫টি পরিবার। এই নদীভাঙনে অনেক অবস্থাসম্পন্ন কৃষক নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন।
কথা হয় গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়নের গান্নারপাড় গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলামের সাথে। তিনি হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘হামার আবাদি জমি, ভিটাবাড়ি, গরু ছাগল সোউগ তিস্তা গিলি খাইছে। এ্যালা মোক মানুষের ভিটাত থাকি কাম করি খাওয়ার নাগচল। সরকার কেন যে হামার গুলার ব্যবস্থা নেয়চোল না।’
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, আরাজি হরিশ্বও, গদাই, পাঞ্জর ভাঙা থেকে চর ঢুসপাড়া পর্যন্ত বেড়িবাঁধ দেয়া খুবই প্রয়োজন। এই বেড়িবাঁধ দিলে তিস্তার ভাঙন থেকে মুক্তি পাবে হাজার হাজার মানুষ।
রংপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তার ভাঙন এখন বাম তীরে। সেই ভাঙনের স্থায়ী সমাধানের জন্য সম্ভাব্যতা ব্যয়ের তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এটির অনুমোদনও হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কাউনিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহিদুল হক বলেন, ইতিমধ্যেই ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। এলাকার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি মহোদয় ভাঙন মোকাবিলার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে একটি ডিও লেটার প্রদান করেছেন। এ ছাড়াও ভাঙন মোকাবিলার জন্য রংপুর পাউবো কর্তৃপক্ষ আশ্বাস প্রদান করেছে।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তার সঙ্গে অন্যান্য অনেক নদীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। সম্প্রতি রংপুরে জনসমাবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে উত্তরের কোটি মানুষের উপকৃত হবে।’
তিনি আরও বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন উত্তরাঞ্চলের মানুষের সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের তেমনি অন্যদিকে শত শত পরিবার তাদের বসতবাড়ি, ফসলি জমি, গাছপালা তিস্তা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য