জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরিশাল শহরের বছরে (জীবন, জীবিকা ও সম্পদের) ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০ কোটি টাকা। যা মোট মূল্য সংযোজন উৎপাদনের ৭ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে মৌসুমী বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে গড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ মিলিয়ন ডলার।
সম্প্রতি জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বন্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন, উপক‚লীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট-ক্লিন ও এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এপিএমডিডি যৌথভাবে বরিশালে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্রমাগত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া উন্নত দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করে তরুণ জলবায়ু কর্মীরা। তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাবের কারণে বিশ্ব এখন একটি সংকটপূর্ণ সময় পার করছে। উন্নত দেশগুলোকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মেনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পাশাপাশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে এখনই উদ্যোগী হতে হবে।
ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের বরিশালের জেলা সমন্বয়কারী মো. সিয়াম সিকদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্তিত্বের সংকট হিসেবে বিবেচনা করে উপকূলীয় জেলা ও শহরগুলোর অভিযোজন ক্ষমতা এবং সহিষ্ণুতা বাড়ানোর জন্য যথাযথ স্থানীয় পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বরাদ্দের সংস্থান করা দরকার। যথাযথ অভিযোজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে মোট ক্ষতির ৬০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে গণমানুষের সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের দাবি তুলেছেন বরিশালের তরুণ জলবায়ু কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
এ ছাড়াও তাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেও ব্যাহত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ হচ্ছে- কীর্তনখোলা নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙনের কারণে দারিদ্র্য ও বাস্তুচ্যুতি, সুপেয় পানির সংকট, অত্যাধিক গরম, অসময়ে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, জলবায়ু উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি, উপকূলীয় অঞ্চলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বাল্যবিবাহ, অপুষ্টি ও পানিবাহিত রোগের বৃদ্ধি প্রভৃতি। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিক থেকেও বরিশাল পিছিয়ে রয়েছে। এসব কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কম।
স্থানীয় অভিযোজনের ওপর বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প তুলে ধরে সমাধানের পথ হিসেবে নগরীর ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন, বন্যা সহনশীল বাড়ি নির্মাণ, খাল খনন, বন্যা সহনশীল শস্যের প্রচার, বাঁধ নির্মাণ, আগাম সতর্কবার্তা প্রদান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বরিশালে সহকারী পরিচালক প্রিন্স বাহাউদ্দিন তালুকদার বলেন, উন্নত দেশে বিলাসী জীবনের দায় আমাদের নিতে হচ্ছে। কারণ পৃথিবী একটাই। আমরা সবাই মানুষ একই আলো-বাতাসে লালিত হই। তাই এ বায়ুকে যারা দূষিত করে তাদের এর দায় নিতে হবে। জল ও বায়ুর প্রতিনিয়ত দূষণের ফল কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে তা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে এখনই সচেতন পদক্ষেপ না নিলে পৃথিবী হতে পারে জীবনের অস্তিত্ব শূন্য।
ক্লিন-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বলেন, বাতাসে কার্বন নির্গমনের ৭২ শতাংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। তাই কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেলে উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ৪০টি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু জার্মানি, জাপান, চীন, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়ামের মতো দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করার কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
এপিএমডিডির সমন্বয়কারী লিডি ন্যাকপিল বলেন, ২০টি দেশ ও কয়েকটি ব্যাংক ২০২২ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও ২০৩০ সালের মধ্যে যদি জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ না করে তাহলে পৃথিবীর উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। তাই অবিলম্বে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করার পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জলবায়ু বিপদাপন্নদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে সহায়তা করা, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নেয়া এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বরিশালের সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ১৯৫০ সালের নদী ও জলাধার সুরক্ষা আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে কোনোভাবেই নদী দূষণ করা যাবে না। নদী দূষিত হলে পরিবেশের ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য, নদীর সঙ্গে যুক্ত ও নির্ভরশীল জীবিকা নষ্ট হয়ে যায়। আবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, নদীকে কোনোভাবেই দূষণ করা যাবে না। সেটি শিল্পকারখানা বা মানুষের ব্যবহারের কারণে হোক।
এ ব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাতের মতো দুর্যোগের শিকার হয়ে মানুষ অভিবাসনে ধাবিত হচ্ছে। কৃষিতে লবণাক্ততা এবং বজ্রপাত এ অঞ্চলের এখন বড় ধরনের সমস্যা। অভিবাসনের কথা মাথায় রেখে প্রকল্পে পরিবর্তন এনেছে সরকার। অভিবাসনে পড়া গৃহহীনরা ঘর পাচ্ছে। কিন্তু অভিবাসনে পড়া মানুষ মধ্যস্বত্বভোগীদের কবলে পড়ে বিপাকে পড়ছেন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য