উৎসমুখে পলি জমে ভরাট হওয়ায় চরম হুমকির মুখে পড়েছে দেশের সর্ব দক্ষিণের উপকূলের বড় সামুদ্রিক মাছের মোকাম মহিপুর-আলীপুর। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের পরিবহন, বিপণন ও বাজারজাত। উৎসমুখ আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ নদীর মোহনার পলি অপসারণে এখনই উদ্যোগ না নেয়া হলে বন্ধ হয়ে যাবে পটুয়াখালীর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের বৃহৎ পাইকারি বাজার। এতে ভবিষ্যতে মৎস্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে পটুয়াখালীর মহিপুর-আলিপুর-খাপড়াভাঙ্গা (শিববাড়িয়া) নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহৎ সামুদ্রিক মাছের পাইকারি বাজার। কিন্তু এই মৎস্য বন্দরের দুই প্রবেশমুখ বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন আন্দারমানিক ও রামনাবাদ নদী মোহনায় জেগে উঠেছে বিশাল ডুবোচর। ফলে গভীর সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ নিয়ে ট্রলারগুলো জোয়ারের সময় বন্দরে প্রবেশ করতে পারলেও ভাটা নাগাদ নদী মোহনায় নোঙ্গর করে থাকতে হয়।
এতে সঠিক সময়ে মৎস্যবন্দরে প্রবেশ করতে না পেরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকার কারণে অনেকের ট্রলারে বসেই নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার মাছ। যে কারণে মাছের সঠিক দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলে ও ব্যবসায়ীরা। ঐদিকে বৈরী আবহাওয়াসহ সমুদ্রে নানা দুর্যোগের কবলে পড়ে মৎস্য বন্দরে আশ্রয় নিতে পারে না অনেক জেলে ট্রলার। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয় নদী মোহনায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রামনাবাদ চ্যানেল থেকে মহিপুর-আলিপুর মৎস্য বন্দরে পৌঁছাতে শিপবাড়িয়া নদীতে নির্মিত শেখ রাসেল সেতুর স্প্যানে স্রোতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ধীরে ধীরে নাব্য কমছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মৎস্য বন্দরে আসা জেলে ট্রলারগুলো। সচেতন মহল বলছেন, অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণে নদীতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে ট্রলারগুলোকে পানিতে ফাঁদে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই ভোগান্তি পোহাতে হয় নদীপথে চলাচল করা স্টিমারসহ বিভিন্ন বড় নৌযানগুলোকে। দীর্ঘ বছর ধরে এ নিয়ে ব্যবসায়ী, ট্রলার মালিক, জেলেরা নদী খননের দাবিসহ দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদকরণে মানববন্ধন করেও কোনো প্রতিকার পায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়সারা ভূমিকায় সাধারণ মানুষের রয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
এদিকে নদীটির দু’তীরে ট্রলার মালিকদের নোঙ্গর করে রাখা অকেজো পুরোনো ট্রলারের বডি, বর্ষা মৌসুমে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোট ব্যবসায়ীদের রাখা ট্রলার, মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ীদের গদিতে মাছ ওঠানোর জেটি, বরফকল মালিকদের বরফ নামানোর জেটি, এসব জেটির পাড়ে নদীর তীরের নির্মিত রাস্তা, নদীর পাড়ে বাঁশ ব্যবসায়ীদের রাখা বাঁশ ও অবৈধ দখলদারদের স্থাপনার জন্য স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পলি জমে নদীটি দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও দেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরের ব্যবহৃত অপচনশীল পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে নদীতে। যার ফলে পূর্ণ যৌবন হারিয়ে ফেলছে খাপড়াভাঙ্গা (শিববাড়িয়া) নদীটি।
চট্টগ্রাম থেকে আসা এমডি আরাফাত নামের ট্রলারের মাঝি সুলতান বলেন, রামনাবাদ চ্যানেল থেকে মহিপুর মৎস্য বন্দরে আসা খুবই কষ্টসাধ্য। কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে বন্দরে আসতে, পানি কমে গেলে বেশ কয়েক ঘণ্টা ট্রলার নোঙ্গর করে বসে থাকতে হয়। অনেক সময় বরফ গলে মাছ পচে যায়। এই নদীটি অতি দ্রুত খনন করা দরকার। তা না হলে এই বন্দর একসময় অকেজো হয়ে পড়বে। আরেক মাঝি রহমত আলী বলেন, দুই পাশেই ট্রলার আটকে যায়, খুব সাবধানে যেতে হয় এই নদী থেকে। একদিকে যেমন বেশি তেল খরচ হচ্ছে অন্যদিকে সময় নষ্ট হয়। এই নদী খনন হলে আমরা নির্ধারিত সময়ে বন্দরে পৌঁছাতে পারব।
মহিপুর মৎস্যবন্দর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজা মিয়া বলেন, ৮০’র দশকে এই নদী অনেক গভীর ছিল। সেই সময় শিববাড়ীয়া নদী থেকেই প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ত। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে এখন আর অন্যান্য মাছও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কুয়াকাটা শাখার সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘নদীর জমির ভরাট করে দু’পাড়ে অবৈধ দখলদাররা আধা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। মৎস্য বন্দরের সব ধরনের অপচনশীল বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুন্দর না হওয়ার কারণে দখল-দূষণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে খাপড়াভাঙ্গা নদীটি।
এ বিষয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম (এমপি) জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটার নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে পাঠানো হলে শিগগিরই নদী মোহনার পলি অপসারণসহ নদীটি খননের কাজ শুরু করা হবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য