-->

ক্যাম্পের বাইরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা, স্থানীয়রাও নেই শান্তিতে

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার
ক্যাম্পের বাইরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা, স্থানীয়রাও নেই শান্তিতে
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির

রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক, সেটা চায় না সন্ত্রাসী গোষ্টী আরসাসহ একাধিক রোহিঙ্গা সংগঠন। তাই প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে বেড়ে যায় হত্যাকান্ড বা সন্ত্রাসী তৎপরতা। বিশেষ করে প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকা রোহিঙ্গারা টার্গেটে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৯টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

 

এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝি বা নেতাদের টার্গেট করছে আক্রমণকারীরা। তাই রোহিঙ্গা নেতাদের অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শিবিরের বাইরে নিরাপদ জায়গায় বাসা ভাড়া করে থাকছেন। এ সংখ্যা লক্ষাধিক হবে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা মাঝি আবদুল হক। সারাদিন তারা সপরিবারে ক্যাম্পের ঝুপড়ি বাসায় থাকে অন্ধকার নামার আগেই চলে যায় ভাড়া বাসায়। সন্ধ্যার পরই তাÐব শুরু হয় সন্ত্রাসীদের। প্রতিটি ক্যাম্পে আরসা আরএসওসহ সন্ত্রাসী সংগঠনসমূহের বেতনভুক্ত এজেন্ট বা সদস্য রয়েছে। এমন ভয়ংকর তথ্য দিয়েছেন রোহিঙ্গা মাঝি আয়াছ রনি।

 

স্থানীয়রা জানান, উখিয়ার ক্যাম্পগুলোয় বছর দেড়েক ধরে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গাদের দুই সন্ত্রাসী গ্রুপ আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলো পরিচালনায় প্রশাসনকে সহায়তার জন্য প্রতিটি শিবিরে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নির্বাচন করা হয়, যাদের বলা হয় মাঝি। তাদের টার্গেট করেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হত্যা মিশনে নেমেছে। তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও প্রাণ হারিয়েছে। দুর্বৃত্তদের গুলিতে ৮ মার্চ নিহত হন সৈয়দ হোসেন নামে একজন, যিনি কুতুপালং ক্যাম্প-২ ডব্লিউর মাঝি ছিলেন। তারও কয়েকদিন আগে হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা মাঝি সৈয়দ হোসেন ও মোহাম্মদ সেলিমকে।

 

কক্সবাজারের আশ্রিত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় থাকা রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাচাইয়ের জন্য ১৫ মার্চ মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসেছিল। তার আগ মুহূর্তে এসব হত্যাকান্ড সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলোর পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করে সাধারণ রোহিঙ্গারা। কেননা তাদের লক্ষ্য ক্যাম্পগুলোয় প্রভাব বিস্তার করে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মতো কর্মকান্ড চালানো।

 

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার উখিয়া বালুখালী ৮ ডব্লিউ ক্যাম্প ও ১৫ নম্বর জামতলীতে জোড়া হত্যার ঘটনা ঘটে। এরা হচ্ছে- আরসার কিলিং স্কোয়াডের সদস্য মো. ইউচুপ ও আরফাত নামের এক কিশোর। ১৫ নম্বর ক্যাম্পে এর আগে উখিয়ায় আরসা সদস্যদের সঙ্গে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে আব্দুল মজিদ ওরফে লালাইয়া নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এপিবিএনের দাবি, নিহত লালাইয়া আরসা কমান্ডার। এ সময় ৩ জনকে আটক করা হয়েছে।

 

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোট ১৩৯ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলতি বছরে সংঘটিত হয়েছে আরো ৪৯টি হত্যাকান্ড। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে। রোহিঙ্গা নেতারা এসব ঘটনার জন্য আরসা ও আরএসওকে দায়ী করছেন। ক্যাম্পগুলোয় দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলেও রাতে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তাই নিরাপত্তাহীনতার কারণে মাঝিদের অনেকে এখন শিবিরের বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। তবে কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।

 

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকান্ড গুলো ঘটাচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা। নিজেদের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের জন্যই তারা এগুলো করছে; যাতে ক্যাম্পে অবাধে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণের মতো কর্মকান্ডের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারে। এটাই তাদের মূল লক্ষ্য।’

 

রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা মামুন। শিবিরগুলোয় কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, দিন দিনই সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে অস্থিরতা বাড়ছে এবং নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মামুন বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী এবং এনজিওগুলোর তৎপরতা থাকে। ফলে দিনে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সন্ধ্যার পর অন্যরকম একটা পরিবেশ তৈরি হয়।’

 

আয়াস নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, আমাদের শিবিরগুলোয় উগ্রবাদী কিছু লোক সক্রিয়। অন্ধকার নামলেই শুরু হয় তাদের তৎপরতা। যখনই সাধারণ রোহিঙ্গারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা করতে চায় বা নিজেরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে, তখনই আরসা আক্রমণ করে।

 

পুলিশ কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখাসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

 

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন সবসময় জীবন বাজি রেখে কাজ করছে। সন্ত্রাসীদের অনেককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ক্যাম্পজুড়ে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version