-->
শিরোনাম

অলিগলিতে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
অলিগলিতে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার
ময়মনসিংহ শহরে গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক

ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়া, ব্রাহ্মল্লী, ভাটিকাশর, বাঘমারাসহ বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠেছে। এর মধ্যে অনেক নিম্ন মানের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোতে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা।

 

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, একটি ১০ শয্যার ক্লিনিকে তিনজন ডিউটি চিকিৎসক ও ছয়জন নার্স সার্বক্ষণিক থাকতে হবে। এর চেয়ে বেশি বেডের প্রতিষ্ঠান হলে দ্বিগুণ ডিউটি চিকিৎসক ও নার্স থাকতে হবে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানে একজন ডিউটি চিকিৎসকও রাখা হয় না।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী চিকিৎসক বা নার্স নেই। রোগী এলে চিকিৎসক ও নার্স ডাকা হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে চিকিৎসা, হচ্ছে অপারেশনও। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের অপারেশন থিয়েটারগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক।

 

সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের চরকালিবাড়ী এলাকার সাজ্জাদ হোসেন রাসেল বলেন, ‘গত মাসে আমার অন্তঃসত্ত্বা শালিকা সাজেদা আক্তারকে পূর্বপরিচিত ইমরান নামের এক লোকের পরামর্শে শহরের বসুন্ধরা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ইমরান ওই হাসপাতালের ম্যানেজার। রাত ১০টার দিকে হাসপাতালটিতে সিজারের পর চিকিৎসক চলে গেলে সাজেদার অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়। ধীরে ধীরে পেট ফুলতে থাকে। এ সময় হাসপাতালে ছিল না কোনো ডিউটি চিকিৎসক। এমতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে ইমরান নিজেই রোগীকে ৪-৫টা ইঞ্জেকশন পুশ করেন। এতে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়।

 

একই এলাকার নজরুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, ‘গত কয়েক মাস আগে আমার স্ত্রীকে দ্বিতীয়বার সিজারের জন্য পরিচিত লোকের মাধ্যমে শহরের এপেক্স হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম। সিজারের পর স্ত্রীসহ নবজাতক সন্তান সুস্থ ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই স্ত্রীর পেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। ধীরে ধীরে পেট ফুলতে থাকে। এমতাবস্থায় ভুল চিকিৎসা হয়েছে এমন সন্দেহ হলে ওই হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে গিয়ে জানানো হয়। তখন হাসপাতাল থেকে জানানো হয় সঠিকভাবেই সিজার করা হয়েছে। অন্য কোনো কারণে ব্যথা করছে। পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের পরামর্শে আল্টাসনোগ্রাফ করা হয়। তখন রিপোর্টে ধরা পড়ে পেটের ভেতর গজ রেখেই সেলাই করা হয়েছে।’

 

ত্রিশাল উপজেলার আউটিয়াল গ্রামের রিকশাচালক আনিসুর রহমানের স্ত্রী হাসিনা। গত ১৭ জুন সকালে হাসিনার প্রসব ব্যথা শুরু হয়। পরে তাড়াহুড়ো করে ওই দিন সন্ধ্যায় নগরীর চরপাড়া ব্রাহ্মপল্লী ১৩/বি হেলথ কেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রূপা আক্তার সিজার করেন। সিজারে ছেলে সন্তান জন্ম দেন হাসিনা। সিজারের পর মা-ছেলে দুজনই সুস্থ ছিলেন।

 

২০ জুন ক্লিনিক থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। তবে ক্ষত সারছিল না। পরে স্থানীয় চিকিৎসক দিয়ে ড্রেসিং করানো হয়। ড্রেসিং করার সময় ক্ষত জায়গায় একটি সুতা পাওয়া যায়। সেলাইয়ের সুতা হবে ভেবে ওই সুতা কেটে ফেলেন স্থানীয় চিকিৎসক। তবে ক্ষত ঠিক হচ্ছিল না। হাসিনা শুধু বলতেন, তার পেটে ব্যথা করে। পরে ২১ জুলাই তাকে কমিউনিটি বেসড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানেও তার অবস্থার অবনতি হলে ১৪ দিন পর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

 

গত ১৪ আগস্ট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় হাসিনাকে। সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ধরা পড়ে জরায়ুতে গজের মতো কিছু একটা রয়েছে। যে কারণে ভেতরে ইনফেকশন হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি অস্ত্রোপচার করাতে হবে। পরে অস্ত্রোপচারে ৭৫ শতাংশ জরায়ু ও ফেলোপিয়ান টিউব কেটে ফেলে দিতে বাধ্য হন চিকিৎসক। মাত্রাতিরিক্ত ইনফেকশন হওয়ায় পায়খানার রাস্তায় বাইপাস করে দেয়া হয়েছে। এখন মৃত্যু পথযাত্রী ওই নারী।

 

ভুক্তভোগী হাসিনার স্বামী আনিসুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য সব মিলিয়ে দুই লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। খুব কষ্ট করে এই টাকা জোগাড় করেছিলাম। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করলে কিছুই হয় না জানতে পেরে মামলা করিনি।’

 

বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক অনার্স অ্যাসোসিয়েশন ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক এবং বসুন্ধরা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এইচ এ গোলন্দাজ তারা বলেন, ‘অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অভিযানকে স্বাগত জানাই। আপনার প্রতিষ্ঠানে ভুল চিকিৎসায় সাজেদা খাতুন নামের এক নারী মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কোনো চিকিৎসক চায় না রোগী মারা যাক। তবুও অনেক সময় মারা গেলে চিকিৎসকসহ ওই প্রতিষ্ঠানের মালিককে দোষারোপ করা হয়। এক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। সঠিকভাবে সিজার করার পরও ওই নারী মারা গিয়েছে। এখানে কারও গাফিলতি নেই।

 

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন ডা. মো. নজরু ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘নগরীর স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে অভিযান চালিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি অনেক অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করেছি। নানা সমস্যায় জর্জরিত এগুলোতে চিকিৎসার নামে শুধু চলত বাণিজ্য।’

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version