প্রতি বছরের মতো এবারো শীতের শুরুতেই ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠছে সিরাজগঞ্জের চলনবিল ও তার আশপাশের এলাকাগুলো। এ সুযোগে শৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিরা বন্দুক, বিষটোপ, জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে এসব পাখি নিধন শুরু করছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাখি নিধন বন্ধে কাজ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে পাখি শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তাড়াশ উপজেলার বারুহাঁস এলাকার মোকাদ্দেস ইসলাম নামে এক কৃষক বলেন, ফসলের জমিতে পানি দেয়ার সময় মাটির নিচে থেকে উঠে আসা পোকামাকড়সহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাদা বক, শালিক, চড়ুই, ডাহুক, চ্যাগা ইত্যাদি পাখি। এ সময় একশ্রেণির পাখি শিকারিরা পতঙ্গের ভেতরে বিষাক্ত কিটনাশক ঢুকিয়ে ছেড়ে দেয়। সেই পোকাগুলো খেয়ে পাখিরা মারা যায়। তখন পাখিগুলো ধরে কাছে রাখা ব্লেড, ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বড় বাঁশের সঙ্গে আকাশের দিকে উঁচু করে বড় ধরনের জাল পেতে রাখা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে পাখিদের তাড়া করলেই পাখিগুলো উড়তে গিয়ে জালে আটকা পড়ে। এই সুযোগে শিকারিরা পাখি ধরে বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখছে। পরে সময়মতো পাখিগুলো বিক্রি অথবা জবাই করছে।
চলনবিলের পরিবেশ উন্নয়ন ও প্রকৃতি সংরক্ষণ ফোরামের সদস্য জুলহাস কায়েম বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত পাখি নিধন রোধে কাজ করছি। তবে স্থানীয় প্রশাসনের জোরালো কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব পাখি শিকার। চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, তাড়াশ, নাটোরের সিংড়া ও গুরুদাসপুর এলাকায় পাখি শিকার বন্ধে নিয়মিত কাজ করছে ‘চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সাল থেকে আমরা চলনবিল এলাকায় পাখি শিকারি বন্ধে কাজ করছি। আমরা মূলত পাখি শিকারিদের নিষেধ ও পাখি অবমুক্ত করে থাকি। এতে পাখি শিকারিরা ততটা ভয় পায় না। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে একটু নজর দিলে কেউ আর অবাধে পাখি শিকার করতে পারবে না।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চলনবিল অঞ্চলে কাজ করছে আরেকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বাধীন জীবন। স্বাধীন জীবনের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক নাসিম জানান, তারা কয়েক বছরে প্রায় দুই হাজার শিকার করা পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছেন।
এ অঞ্চলে আরো এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দি বার্ডস সেফটি হাউসের চেয়ারম্যান মামুন বিশ্বাস বলেন, চলনবিল অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবী কিছু সংগঠন পাখি রক্ষায় কাজ করছেন। তারা শিকার করা পাখি অবমুক্ত করলেও তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতার অভাব ও সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ের অভাবে এ বিলে স্থায়ীভাবে পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
চলনবিলে পাখি নিধন বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী পাখি নিধন দন্ডনীয় অপরাধ। আর শীত বা বর্ষার মৌসুম শেষে শরৎকালে খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য দেশীয় পাখি চলনবিলে যায়। এসব পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, সৌন্দর্য বর্ধন এবং ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশকে রক্ষা করে।
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাখি শিকার একটি অপরাধ। তবে কেউ পাখি শিকার করছে এমন সংবাদ পেলে অবশ্যই ঘটনাস্থলে গিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেব।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আহম্মেদ নিয়ামুর রহমান বলেন, বন বিভাগে জনবল সংকট রয়েছে। এ কারণে আমরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছি না। তবে আমরা পাখি শিকারের তথ্য পেলে অভিযান পরিচালনা করে পাখি শিকার বন্ধের চেষ্টা করি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য