পানির প্রাথমিক ও সহজলভ্য মূল্যবান উৎস হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানি। সীতাকুন্ডে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা। মূলত নাগরিক চাহিদা পূরণ ও সেচ প্রকল্পে গভীর-অগভীর নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে নিচে নামছে পানির স্তর। জাতীয় পানিনীতি ১৯৯৯ সহ সরকারের অন্যান্য নীতিমালা উপেক্ষা করে অপরিকল্পিত নগরায়ন শিল্পায়নের প্রভাব আর ভূ-উপরিভাগের নদনদী, খালবিল ও পুকুর ভরাটসহ পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে অশনিসংকেত দেখছেন গবেষকরা।
সীতাকুন্ড পৌর এলাকায় হস্তচালিত নলক‚প প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। আর গভীর নলকূপগুলোতে উঠছে না পর্যাপ্ত পানি। এমতাবস্থায় এবার উপজেলায় আগে ভাগেই খরা পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সীতাকুন্ড সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) লেফটেন্যান্ট মো. দিদারুল আলম, বড় কুমিরার বাসিন্দা সিনিয়র আইনজীবী ও চট্টগ্রাম জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মো. খালেদ শাহনেওয়াজ, ইঞ্জিনিয়ার মো. কামরুদ্দৌজা ও কেদারখীলের বাসিন্দা মো. নুরুল করিম চৌধুরী জানান, আশানুরূপ বৃষ্টি না হওয়ায় নদীনালা, খালবিল ও পুকুরগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। ফলে অনেক এলাকায় চাষাবাদে ভূ-উপরিভাগের স্বাভাবিক পানি মিলছে না।
এমন পরিস্থিতিতে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর নির্ভরতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানির স্তর ইতোমধ্যে ৪ থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে গেছে। এমনিতেই ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ২৬ ফুটের নিচে নামলে নলকূপে চাহিদা মতো পানি উঠে না। এবার ওই পানির স্তর উপজেলার কোনো কোনো এলাকায় এখনই ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে।
সূত্র জানায়, ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। নদীনালা ও খালবিলে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় পাওয়ার পাম্পে নদীনালার পানিতে সেচ এখন নেই বললেই চলে। ফলে নদীনালা ও খালবিলের পাড়েও বসেছে গভীর নলকূপ। খাবার পানিও উঠছে গভীর নলকূপে। সেচযন্ত্র দিয়ে পানি উত্তোলনের ফলে মাটির নিচের পানির স্তরে চাপ পড়ছে। ফলে সুপেয় পানির উৎস যেমন কমছে, তেমনি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে কৃষিখাত। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে বাড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি।
খাবার পানিসহ রান্না, গোসল ও চাষাবাদে পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যবহার হয় ভূ-গর্ভস্থ স্তর থেকে। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশে গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয়। তখন মাত্র ৩০ থেকে ৪০ ফুট নিচে নলকূপ বা টিউবওয়েল বসিয়েই পানি পাওয়া যেতো। আর এখন ১৬০ ফুট নিচেও পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত পানি। অথচ একযুগ আগেও ৬০-৭০ ফুট নিচে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যেত।
সীতাকুন্ড পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ বদিউল আলম বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পৌরবাসীদের মতো আমিও দুর্ভোগের শিকার। তবে একথাও সত্য যে, নগরায়ন-শিল্পায়নের প্রভাবসহ ভৌগোলিক সু-অবস্থান বিবেচনায় সীতাকুন্ড পৌর এলাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে জনবসতি। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন। বাড়ছে বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাড়তি জনসংখ্যার জীবন-জীবিকাসহ ব্যবহার্য কাজে মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব পড়ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর।
আবার পৌর এলাকার বড় বড় দীঘি ও পুকুরগুলো ব্যবহার অযোগ্য হয়ে মাছ চাষের প্রজেক্টে পরিণত হয়েছে। এদিকে আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবও পড়ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর। এমতাবস্থায় নাগরিক চাহিদা পূরণ, কৃষি ও সেচ প্রকল্পে গভীর-অগভীর নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে নিচে নামছে পানির স্তর।
উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, স্বাভাবিক নিয়মে ভূ-গর্ভস্থ পানির যে স্তরটুকু খালি হয়, তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবে পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও অনাবৃষ্টির কারণে তা আর হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকি। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ পানির প্রাকৃতিক উৎস সংরক্ষণ করতে হবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য