-->
শিরোনাম
ভয়ানক সেই সিডর

স্বজন হারানো বেদনায় আজও কাঁদে উপকূলবাসী

কাশেম হাওলাদার, বরগুনা
স্বজন হারানো বেদনায় আজও কাঁদে উপকূলবাসী
ক্যাপশন: সিডরের তান্ডবে উপকূলীয় জনপদে ধ্বংসযজ্ঞ (ফাইল ছবি)

১৫ নভেম্বর, ২০০৭ সালের এই দিনে বিভীষিকাময় সিডরের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় জনপদগুলো। অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে এই এলাকায়। সত্তরভাগ ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায় প্রকৃতির করাল থাবায়। হাজার হাজার পরিবার স্বজন হারিয়ে হতবিহবল হয়ে পড়েন। ফসলের ক্ষেত, গবাদি পশুপাখি, পুকুর-ঘেরের মাছ, রাস্তাঘাটসহ সামাজিক সম্পদগুলো তছনছ হয়ে যায় আকস্মিক মহাদুর্যোগে।

 

রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটিকে স্মরণ করা না হলেও মিলাদ মাহফিল, দোয়া মোনাজাত কোরআনখানি ও নানাবিধ পারিবারিক আয়োজনে দিনটিকে স্মরণ করছে উপকূলীয় এলাকার স্বজনহারা শোকার্ত পরিবারগুলো। এ ছাড়াও বরগুনা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে প্রতিবছরের মতো এ বছরও বরগুনা জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনপথ নলটোনায় সিডরে নিহতদের গণকবরে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সিডরের ওই রাতে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াল সামুদ্রিক জলোচ্ছাস ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চল লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। উপকূলীয় অঞ্চলের শত শত মানুষের জীবন প্রদ্বীপ নিভে যায়। নিখোঁজ হয় বহু মানুষ। প্রাণহানি ঘটেছিল হাজার হাজার মানুষের। মারা গিয়েছিল হাজার হাজার গবাদিপশু।

 

দক্ষিণাঞ্চলের জনপদগুলো ছিল মানুষের কোলাহলে মুখরিত, মাঠজুড়ে ছিল কাঁচা-পাকা সোনালি ধানের সমারোহ। মুহূর্তেই সেই জনপদের কোনো চিহ্ন ছিল না। ধ্বংসের তান্ডব লীলায় পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। ১৬ বছর পরে সেই স্মৃতি নিয়ে আজও যারা বেঁচে আছেন এবং তাদের মধ্যে যারা আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন, সেই বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়লেই আঁতকে ওঠেন তারা।

 

জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্ন চাপে সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নিম্ন চাপটি কয়েকবার গতি পরিবর্তন করে রাত ১০টায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। রাতে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় বাংলাদেশে। ঝড়ের তীব্রতা কমে যাওয়ার পর শুরু হয় স্বজনদের খোঁজাখুঁজি। কারও বাবা নেই, কারও মা নেই।

 

আবার কারও নেই স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন , দাদা-দাদি, নানা-নানি, মামা-মামি, খালা-খালু, চাচা-চাচি। গাছের ডালে কিংবা বাড়িঘরের খুঁটির সঙ্গে ঝুলে ছিল স্বজনদের লাশ। যেদিকে চোখ যায় শুধু লাশ আর লাশ। সাগর ফুলে প্লাবিত হয় উপকূলীয় জনপদ। ৮-১০ ফুট উচ্চতায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধ টপকিয়ে মুহূর্তেই স্রোতের ধাক্কায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় লোকালয়। উপকূলের বাতাসে ভেসে বেড়ায় মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের আর্তচিৎকার আর স্বজন হারানোর আহাজারি।

 

স্বজন হারানো একবুক ব্যথা নিয়ে এখনো হতবিহবল রয়েছেন বরগুনার তালতলী উপজেলার কবিরাজপাড়া গ্রামের খলিল হাওলাদার। সিডরের প্রলয়ংকরী দুর্যোগে হারান একই পরিবারের ১১ সদস্যকে। প্রবল ঝড়ে বসতঘর উড়ে যাওয়া শূন্য ভিটায় উপরে পরিবারের ১১টি কবর কালোরাতের ভয়াল স্মৃতি তাকে ভয়ার্ত করে ফেলে প্রতিনিয়ত। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পরিবার-পরিজন নিয়ে সাগরকূলীয় চর এলাকা আশারচরে অস্থায়ী বসতি গড়েছিলেন খলিল হাওলাদার।

 

ছোট-বড় মিলিয়ে ১৮ জনের সদস্য নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার তাদের। কেউ পোনা ধরেন, কেউ শুঁটকি শুকান, কেউ গড়াজালে মাছ ধরেন, কেউ অন্যদের আহরিত মাছ বা শুঁটকি পাইকারি বিক্রেতা হিসেবে ব্যবসা করেন। পরিবারের দু’একজন নারী সদস্য ব্যতিত সবারই দিন কাটত আয়-রোজগারে।

 

সমুদ্রতীরবর্তী একটি অরক্ষিত বসতঘরে ঠাঁই নেয়া ১৮ সদস্যের নারী ও শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে যাওয়ার জন্য বারবার গৃহকর্তা খলিল হাওলাদার তাগিদ দিলেও সম্পদ ও মায়ার কারণে স্থান ত্যাগ করেনি কেউ। সেদিন উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে নিমিষেই রাত ১০টার দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সবাই। প্রলয়ংকরী সিডরের পরের দিন আশারচর সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার আনাচে কানাচে খাল-বিল-ডোবায় দেখা যায় অসংখ্য ভাসমান লাশ। বেশকিছু মৃতদেহ ছিল গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায়।

 

১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি স্বজনহারাদের মাঝে দুঃস্বপ্নের মতো আজও তাড়া করে বেড়ায় তাদের। আজও ভুলতে পারেননি সেই ভয়াল রাতের লোমহর্ষক স্মৃতি। স্বজন হারানো বেদনায় আজও কাঁদেন তারা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version