দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটন খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর হরতাল-অবরোধের কারণে এ খাতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দেশে সাধারণত পর্যটনের মৌসুম ধরা হয় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কাল। এ হিসেবে এখন পর্যটনের ভরা মৌসুম। অথচ সবকটি পর্যটনকেন্দ্র কার্যত ফাঁকা। হরতাল-অবরোধে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ থাকছে সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেন ও দূরপাল্লার বাসে আগুন দেয়ার পর অনেক পর্যটকই নির্ধারিত ভ্রমণ বাতিল করছেন। এ অবস্থায় বর্তমানে পর্যটনকেন্দ্রগুলো খাঁ খাঁ করছে।
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, চলমান সংকটের সমাধান না হলে পর্যটনসহ সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যেই মৌসুমের দুইটি মাস শেষ হচ্ছে। গেল ২ মাসে কোনো ব্যবসা না থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমল, বার্মিজ মার্কেট, শুঁটকি মার্কেট, যানবাহন, শামুক ও ঝিনুক মার্কেট, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, করোনার ব্যবসায়িক ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হরতাল-অবরোধের কারণে এ খাতের মরণদশা। মানুষ ঘুরতে যায় আনন্দ করতে, কেউই চাইবে না কোনো ধরনের আতঙ্কের মধ্যে থাকতে। ফলে যেসব পর্যটনকেন্দ্রে মানুষ সবচেয়ে বেশি ঘুরতে যায়, সেসব পর্যটনকেন্দ্র এখন একেবারেই খালি। বিমানে কিছু পর্যটক আসা-যাওয়া করলেও তা উল্লেখ করার মতো নয়।
তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে। কারণ, নভেম্বর প্রায় শেষ, ডিসেম্বরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে এমন লক্ষণ আমরা দেখছি না। জানুয়ারিতে নির্বাচন। ফলে মৌসুমের ৪ মাসের মধ্যে ৩ মাস কোনো ব্যবসা হবে না। আর ফেব্রুয়ারিতে ব্যবসা করে খরচও ওঠানো যাবে না। কারণ, সারা বছরের ব্যবসা হয় এই ৪ মাসে।
ঢাকার মালিবাগের বাসিন্দা ব্যবসায়ী নসরুল হামিদ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, গত ৪ ও ৫ নভেম্বর সপরিবারে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এজন্য তিনি কক্সবাজারের একটি পাঁচতারকা হোটেলে তিনটি রুম বুকিং করেন। পরে ওই দুই দিন হরতাল-অবরোধের কারণে কক্সবাজারে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেন। এতে হোটেল কতৃপক্ষ একদিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন অন্যদিকে ওই ব্যবসায়ী তার ভ্রমণ বাতিল করে চলে যান সপরিবারে নেপাল।
এভাবে অনেক পর্যটক শুষ্ক মৌসুমে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পট না এসে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনের সভাপতি মুকিম খান। দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলসহ প্রায় সবকটিই এখন পর্যটকশূন্য।
কক্সবাজারের তিন তারকা হোটেলের ম্যানেজার শামীম হাসান বলেন, অবরোধ-হরতালের কারণে কক্সবাজার পর্যটকশূন্য। বিমানে কিছু পর্যটক আসছেন, তাও একেবারে নগণ্য। তিনি বলেন, হোটেলের রুম ভাড়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ছাড় দেয়ার পরও পর্যটক পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি অনেকে আগে থেকে ডিসেম্বরের জন্য রুম বুকিং দিলেও এখন তা বাতিল করছেন। বর্তমানে মাত্র ১০ শতাংশ রুম ভাড়া দেয়া যাচ্ছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে অন্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। হরতাল-অবরোধের কারণে পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
কক্সবাজার হোটেল গ্র্যান্ড সেন্ডির মালিক আবদুর রহমান বলেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকের আনাগোনা নেই। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে না হতেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটকদের আনাগোনা আবার থমকে গেছে। ফলে এবারের মৌসুমে ব্যবসায়ীদের নিশ্চিতভাবেই অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১ হাজার ৪০০ পর্যটন স্থান রয়েছে। এর মধ্যে ২৮১টি স্থানে পর্যটকরা নিয়মিত যান। প্রতিবছর এসব পর্যটনকেন্দ্রে প্রায় ২ কোটি দেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। পর্যটক আকর্ষণ বাড়াতে ও রাতের বিনোদনের জন্য মাত্র ক’দিন আগে কক্সবাজারে মাসব্যাপী শুরু হয়েছে শিল্প ও বানিজ্যমেলা। কিন্তু সেখানে নেই কোনো কোলাহল। আর কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের প্রতিটি পয়েন্ট এখন নীরব। বন্ধ হয়ে গেছে কক্সবাজার শহরের আড়াইশ রেস্তোরাঁ। হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে প্রতিদিন ছাঁটাই করা হচ্ছে কর্মচারী।
কক্সবাজার চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল ও বিপণীবিতানসহ পর্যটন সেক্টরে গত ২ মাস ধরে দৈনিক ১৫/১৬ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
ভোরের আকাশ/ আসা
মন্তব্য