স্বচ্ছ পানির নদী হিসেবে তিস্তার-ধরলার পরিচিতি। নাব্য সংকটে বর্ষায় অল্প পানিতেই উপচে পড়ে। ভাঙে ঘরবাড়ি, ক্ষেত-খামার। তবে শুষ্ক মৌসুমে সম্পূর্ণ বিপরীত। জেগে ওঠা চরগুলো ফুলে-ফসলে ভরে ওঠে। বাদাম, ভুট্টা, আলু, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা ফসল চাষে ব্যস্ত ও মুখরিত সময় পার করেন চরের কৃষকরা। অন্যবারের তুলনায় এবার তারা আরও বেশি খুশি।
সিকিমের চুংথাং বাঁধ ভেঙে একদিনে ভেসে যায় তিস্তা। তখন দুর্গতির কমতি না থাকলেও এখন তিস্তা পাড়ে খুশি। ওই বন্যায় স্মরণকালের সব থেকে ঘোলাটে পানি আসে। পানি কমে গিয়ে তিস্তার চকচকে বালির ওপর ১ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত পলি জমেছে। আর এই পলিযুক্ত বালিতে অল্প সার, পানি ব্যবহার করেই ফলাচ্ছেন ফসল।
ইতোমধ্যে চরে চাষকৃত আমনের ব্যাপক ফলন হয়েছে। বাদামসহ বেশ কিছু সবজি চাষেও মিলেছে সাফল্য। সম্ভাবনা দেখাচ্ছে আলু, ভুট্টা, তামাক, রসুন, মিষ্টি কুমড়াসহ অর্থকরী ফসলগুলো।
কৃষি অধিদপ্তরের মতে, গেল রবি মৌসুমে ৮ হাজার ৫০০ হেক্টর চাষাবাদের আওতাভুক্ত ছিল। তবে তিস্তার চরে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমি আছে। প্রতিনিয়ত নতুন চরকে চাষযোগ্য করা হচ্ছে। যেখানে শুধু বালি আছে সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা করে চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। রবিশস্য, ধান, পাট, আলু, বাদাম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মরিচ, ডাল এসব অর্থকরী ফসল চরাঞ্চলেই বেশি উৎপাদন হয়।
সদর উপজেলার খুনিয়াগাছের কৃষক মোফা মিয়া বলেন, ‘এবার নিচু কিছু স্থানে ২/৩ ফুট পলি জমেছে। বালুর ওপর এমন পলি আমার জীবনে দেখিনি। এবার যা-ই লাগানো হচ্ছে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের কৃষক রেজাউল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘এবার ভারতের বাঁধ ভেঙে অনেক বেশি ঘোলা পানি এসেছে। এমন ঘোলা পানি কখনও আসেনি। সাদা বালু কালো হয়ে গেছে। এবার খুব ভালো ফলন হচ্ছে।’
একই ইউনিয়নের রাব্বানি আজিজার বলেন, ‘যেখানে কখনও ধান হতো না এবার সেখানে ধান হয়েছে। অন্যবার যে চরে সার-পানি দিয়ে বিঘায় ৬ মণ ধান হতো এবার সেখানে ১৮ থেকে ২০ মণ পর্যন্ত ধান হয়েছে।’
কালিগঞ্জের চর শৌলমারির কৃষক আব্দুর রহিম মিষ্টি কুমড়া লাগিয়েছেন ২৮ দিন আগে। এখন পর্যন্ত কোনো সার কীটনাশক প্রয়োগ করেননি। গাছ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ৪-৫ ফুট লম্বা হয়েছে। আশা করছেন এবার খুব কম খরচে বেশ ভালো ফল পাবেন।
ভোটমারি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘চরে আমার দুই জায়গায় ৪ একর পর্যন্ত বালুতে মিষ্টি কুমড়া চাষ হচ্ছে। কৃষি ঊদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে মিষ্টিকুমড়া ও তরমুজ চাষ হচ্ছে। তরমুজের সাথি ফসল হিসেবে ক্ষীরা চাষ হচ্ছে। এ ছাড়াও ভুট্টা, ধান, পেঁয়াজ, পেঁয়াজ বীজ, লাউ, গমসহ অন্যান্য ফসল চাষ হচ্ছে।’
মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ‘উঁচু স্থান বা পাহাড় থেকে যে পানি আসে তা বিভিন্ন নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি নিয়ে আসে। বন্যার পানিতে কয়েকটি স্তর আছে। প্রথমত তিনটি স্তর; বালি, পলি, ফেনা। বালির ওজন বেশি হওয়াতে প্রথমে বালিটা পড়বে তারওপর পলি বা ঘোলা এবং তারওপর ফেনা। যেখানে শুধু বালি পড়বে সেখানে ভালো জমিও নষ্ট হয়ে যাবে। আর পলির সঙ্গে পানির যে ফেনা অংশ থাকে এটা পড়লে যেকোনো অনুর্বর জমি উর্বর হবে। এটা আশীর্বাদ। সাধারণত ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত পলি জমে।’
লালমনিরহাট কৃষি দপ্তরের উপ-পরিচালক (শস্য) সৈয়দ সিফাদ জাহান ভোরের আকাশকে বলেন, পলি প্রতি বছর পড়ে। এবার সিকিমের বন্যার পরে বেশি পড়েছে। এখন পর্যন্ত প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ০২ মেট্রিক টন (চালের হিসাব) আমনের ফলন পাওয়া গেছে। চূড়ান্ত হিসাব এখনও করা হয়নি।
পলি পড়ার ফলে প্রচুর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জমিতে থাকে। জমির অপুষ্টির লক্ষণ প্রকাশ না ঘটলে রাসায়নিক সার দিতে হবে না। তবে কিছু জমিতে মাটির কিছু খাদ্য উপাদান দিতে হতে পারে।’
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য