এমন দৃশ্যে চোখ চানাবড়া। মাস দু’য়েক আগেও যেখানে ছিল সারি সারি সেগুন, আকাশমণি, মেহগনী, রেইন্ট্রিসহ নানা প্রজাতির বিশাল আকারের সবুজ বৃক্ষ। এখন সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফেলে যাওয়া গাছের মোথা আর ছোট আকারের গাছ, মরা ডালপালা ও পাতা।
জানা গেছে ওখান থেকে কেউ রাতের আঁধারে এসব গাছ উধাও করছে। আবার অনেকেই প্রকাশ্যে এসব ৩০-৩৫ বছরের পুরানো বৃক্ষ অবাধে কেটে সাবাড় করেছেন। ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশেই প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকার মনু নদ প্রতিরক্ষা বাঁধের প্রায় ৯ কোটি টাকা মূল্যের বৃক্ষ উধাও হয়েছে। কেটে নেয়া গাছের দৃশ্যমান অবশিষ্ট অংশই (গোড়া) এখন এমনটিই জানান দিচ্ছে।
সংঘবদ্ধ একটি বৃক্ষ খেকো চক্র বন বিভাগের সঙ্গে যোগসাজশে এসব মূল্যবান গাছ পাচার করেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের তরফে অভিযোগ উঠেছে। এত গাছ কেটে নিলেও বন বিভাগ বা পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো আপত্তি জানায়নি। বরং সরকারি এই দুটি বিভাগ একে অন্যকে দায় ও দোষারোপ করেই নিজেদেরকে আড়াল করছেন। এ নিয়ে পরিবেশবাদী, সচেতন মহল ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
জানা যায়, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শ্রীরাই নগর থেকে কাজিরবাজার পর্যন্ত ৩০ ফুট চওড়া মনু নদ প্রতিরক্ষা বাঁধের সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকা থেকে প্রায় ৬ হাজার বনজ বৃক্ষ কেটে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৯ কোটি টাকা নিরূপণ করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণে নতুন প্রকল্পের আওতায় নদীর পূর্বের বাঁধ উঁচু করা ও ব্লক স্থাপনের কাজ হাতে নেয়। এই ঘোষণা চাউর হলেই পরিকল্পিতভাবেই গাছ উজাড় করে সংঘবদ্ধ একটি চক্রটি।
আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে দৃশ্যমান এমন ঘটনায় বন বিভাগের কোনো পদক্ষেপ বা ভূমিকা না থাকায় জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বন বিভাগ বলছে ওখানে সামাজিক বনায়নের কোনো গাছ নেই। তবে ওখানকার নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া মালিকানা নিয়েও নানা বির্তক ও আইনি জটিলতা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বলছেন মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধের ৮৫ কিলোমিটার জমির মালিকানা নির্ধারণ ও গাছ মার্কিং করার জন্য চলতি বছরের প্রথম দিকে বন বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়।
কিন্তু দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হলেও বন বিভাগ তা আমলে নেয়নি। গাছ কেটে নেয়ার পর অনেকটা তোপের মুখে তারা মাঠে তৎপর হয়েছেন। অপরদিকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন মাস দুয়েক আগে ১৩ মৌজার (রাজনগর উপজেলার) জমি ও গাছ মার্কিংয়ের চিঠি পেয়ে তারা কাজ করছেন। মৌলভীবাজার সদরের ৮ মৌজার চিঠি এখনো পাননি। তবে লোক মারফত মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় গাছ কাটার খবর পেয়ে তাদের আইন ও এখতিয়ারনুযায়ী বিষয়টি দেখছেন। ইতিমধ্যে ওই ঘটনার তদন্তে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
সম্প্রতি সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের বীর নিবাসের পাশে সরকারি ভূমি থেকে অর্ধশতাধিক সেগুন গাছ মধ্যরাতে কেটে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা কেটে নেয়া ব্যক্তিকে চিনলেও ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না।
কামালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আপ্পান আলী জানান তার পরিষদ কার্যালয়ের পাশ থেকে প্রায় ৪৫-৫০টি বড় আকারের সেগুন গাছ রাতের আঁধারে কেটে নেয়া হয়েছে। বড় গাছ পাচার হওয়ার পর বন বিভাগ অবশিষ্ট ছোট গাছগুলো মার্কিং করে। তিনি এর প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল জানান, একটি প্রকল্পের আওতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ উঁচু করা ও ব্লক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ৮৫ কিলোমিটার বাঁধের জমির মালিকানা নির্ধারণ ও গাছ মার্কিং করার জন্য চলতি বছরের ১লা ফেব্রুয়ারিতে বন বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু তারা কি কারণে ওই কাজ বিলম্ব করলেন তা আমাদের জানা নেই।
বন বিভাগের মৌলভীবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মজনু প্রামানিক বলেন জমির মালিক যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তাদের উদ্যোগ নেয়ার কথা। এসব জমির মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক বিভাগ, ডিসির খতিয়ান ও সামান্য ভূমি ব্যক্তি মালিকানা রয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মূল্য নির্ধারণ করে গাছ মার্কিংয়ের বিষয়ে কোনো চিঠি দেয়া হয়নি বলে তিনি জানান।
তবে এতগুলি দৃশ্যমান গাছ কাটা হলো বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে বন বিভাগের ভূমিকা কি এমন প্রশ্নে নানা অজুহাতে তিনি নিজেদের আড়ালের চেষ্টা চালান।
পরিবেশবাদী সংগঠন বাপার জাতীয় পরিষদের সদস্য আসম ছালেহ সুহেল বলেন, চোখের সামনে কয়েক হাজার গাছ উধাও হলো অথচ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নির্বিকার। বন বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কখনো নিজেদের দায় এড়াতে পারেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যারাই রক্ষক, তারাই ভক্ষক।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য