-->
শিরোনাম

ভাঙনের কবলে পদ্মা, হারাচ্ছে গতিপথ

অদূরদর্শীতার মাশুল হাজার কোটি টাকা

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
ভাঙনের কবলে পদ্মা, হারাচ্ছে গতিপথ
কুষ্টিয়ায় পদ্মাপাড়ে ভাঙন

প্রমত্তা পদ্মার গতিপথের পরিবর্তন হয়েছে। এতে নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো ভাঙনের কবলে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছে জনবসতি, ফসলি জমি, ভবনসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। যদিও ভাঙন রোধে গেল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাশ হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা পদ্মার গতিপথ পরিবর্তনের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নদী তীরে গ্রোয়েন (বাধ) নির্মাণকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, সময়মতো কিছু টাকা ব্যয়ে গ্রোয়েনের বিপরীত অংশে প্রতিরক্ষা বাধ নির্মাণ করা গেলে সরকারের এই হাজার কোটি টাকার ব্যয় সংকোচন করা যেত; ওই এলাকাতে ভাঙনও হতো না। এসবের দায় দিচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের।

 

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিমভাবে কোনো নদীরই গতিপথ পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তবে জনস্বার্থে অনেকসময় সেটি করা হয়ে থাকে। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলা ঘেঁষে প্রবাহিত পদ্মা নদী চার বছর আগে যে প্রবাহ চ্যানেলে ছিল এখন সেখানে নেই। নদীর বামতীরে গ্রোয়েন (বাঁধ) নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যে কারণে নদী এখন ডানতীর ঘেঁষে প্রবাহিত হচ্ছে; গুগল ম্যাপ দেখলেই সেটি স্পষ্ট হওয়া যায়।

 

নদী বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, পাউবোর গাফিলতির কারণে এরইমধ্যে ভাঙনের কারণে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আবার এটি প্রতিরোধে সরকারের দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প দিতে হয়েছে। অথচ, সেই সময়ে পাউবো থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হলে এর কোনোটিই হতো না।

 

জেলা পাউবোর মরফোলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রইচ উদ্দিন জানান, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলা ঘেঁষে প্রবাহিত পদ্মা নদী চার বছর পূর্বে যে প্রবাহ চ্যানেলে ছিল এখন সেখানে নেই। বামতীরে গ্রোয়েন (বাঁধ) নির্মাণের কারণে নদী এখন ডানতীর ঘেঁষে প্রবাহিত হচ্ছে।

 

জানা গেছে, কুষ্টিয়ার হার্ডিঞ্জ রেল সেতু ও লালন শাহ সেতুলাগোয়া ভাটিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের পোর্ট নির্মাণে পদ্মা নদীর বাম তীরে মূল প্রবাহ চ্যানেলের মধ্যে প্রায় ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের গ্রোয়েন (বাঁধ) নির্মাণ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এরপর থেকেই নদীর ডান তীরে ভাঙন শুরু হয়। এভাবে গেল কয়েক বছরে পদ্মা প্রকৃত গতিপথ হারিয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর জমি। এ নিয়ে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দায় দিচ্ছেন নদী ও পানি সম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরুতেই নদীর ডান তীরে মাত্র ২ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাধ দিলে সুরক্ষিত থাকতো নদীর গতিপ্রকৃতি। এতে এই জনপদ ঝুঁকিমুক্ত থাকতো, লাঘব হতো সরকারের হাজার কোটি টাকার ব্যয়।

 

স্থানীয় সংসদ সদস্য বলেন, ‘পদ্মা নদীর বাম তীরে রূপপুর বাধ নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা একই সময়ে ডান তীরে সামান্য কিছু প্রতিরক্ষামূলক কাজ করলেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেত ভেড়ামারা-মিরপুরের বিস্তীর্ণ জনপদ। দেরিতে হলেও সরকার সমস্যাটি সনাক্ত করে সমাধানে প্রকল্প নিয়েছে। ক্ষতি যা হবার হয়েছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে নতুন করে আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না।

 

জানা গেছে, গতিপথ পরিবর্তনের কারণে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, মিরপুর, সদর ও কুমারখালী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়সহ গোটা জনপদ চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি, বসতভিটা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলসহ ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী মহাসড়ক ও জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প (গঙ্গা-কপোতক্ষ), ৪১০ মেগা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনা। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের অদূরদর্শীতা, অবহেলা ও অদক্ষতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. এনামুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, কুষ্টিয়ার স্থানীয় জনসাধারণ যেটা বলছে সেটা ঠিক। সেখানে গ্রোয়েন নির্মাণের ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে, ভাঙন হয়েছে। এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে। সেখানে এখন অপচয়মূলক কাজ হচ্ছে এই অর্থে যে শুরুতেই একটা ব্যবস্থা নিলে এত টাকার খরচ হতো না। আমি জনগণের সঙ্গে একমত। এখানে তখন এসব পদক্ষেপ না নেওয়াটা সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শীতা।

 

মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হান্নান মন্ডল বলেন, ‘নদীর বাম তীরে বাধ নির্মাণ দেখে ৩ বছর আগে থেকেই আমরা সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা ভেবে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে সমাধানের দাবি করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্ব দেয়নি।’

 

কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও নাগরিক কমিটির সভাপতি ডা. এসএম মুসতানজি বলেন, ‘দেশের এক্সপার্টরা কেনো বুঝলেন না যে, রূপপুর গ্রোয়েন নির্মাণের বিরূপ প্রভাবে নদীর গতি প্রকৃতির সম্ভাব্য পরিবর্তন ও তার ভয়াবহতা কি হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জলপথ যানবাহনের জন্য সাধারণত পানিপ্রবাহকে সুরক্ষিত রেখে ফ্লটিং পোর্ট নির্মাণ করে। আমাদের দেশেও আছে, সেই প্রযুক্তি রূপপুর প্রকল্পেও গ্রহণ করা যেত কি না সেটা ভেবে দেখা যেত।’

 

এসব বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনসহ নানা কারণ থাকতে পারে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে রূপপুর গ্রোয়েনও একটা কারণ। এর বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট সংকট নিরসনে গৃহীত প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাধ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেই সেখানে নদী ভাঙন বন্ধে স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে। যে কোন ধরনের উন্নয়নেই তার কিছু নেতিবাচক প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। তবে সেটি যেন টেকসই উন্নয়ন অভিযাত্রার বিচ্যুতি না ঘটে। সেদিকটাকে গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত।

 

নদ-নদীর প্রাকৃতিক অবস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে।'

 

ভোরের আকাশ/মি

 

মন্তব্য

Beta version