খুলনায় সরকারের ওএমএসের কার্যক্রমে আটা সরবরাহকারী বেসরকারি মিল মালিকদের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দেড় থেকে দু’বছর মিল বন্ধ থাকলেও তাদের নিয়মিতভাবে গম বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। খাদ্য বিভাগের সঠিক তদারকির অভাবও বরাদ্দের নীতিমালা না মানার সুযোগ নিয়ে আটা মিল মালিকরা বরাদ্দপ্রাপ্ত গম খোলা বাজারে বিক্রি করে নিম্নমানের আটা কিনে সরবরাহ করছে।
ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ওএমএসের মাধ্যমে নিম্নমানের আটা কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এ নিয়ে হতদরিদ্র মানুষ ও সুশীল সমাজের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এতে সরকারের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ ও নিম্নআয়ের মানুয়ের জন্য সঠিক পুষ্টিকর খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হতদরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা প্রদানের সরকারের অর্জিত সুনাম নষ্ট হচ্ছে। সংবাদকর্মীদের তথ্য অনুসন্ধানে আটা মিল মালিক ও খাদ্য বিভাগের অনিয়মের বিষয় উঠে আসলে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর সূত্র ধরে আঞ্চলিক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর যৌথভাবে তদারকি ও পরিদর্শন এবং তদন্ত কমিটি করে ৪টি মিলে অনিয়মের সত্যতা পেয়ে বরাদ্দ স্থগিত করেছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্রে জানা গেছে, মিল মালিকদের বিরুদ্ধে ওএমএস ডিলারদের নিম্নমানের আটা সরবরাহের অভিযোগ ও সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তাজুল ইসলামের নির্দেশে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাদল কুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বে খাদ্য পরিদর্শক পল্লব ঘোষ ও শফিকুল ইসলামকে সদস্য করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই সাথে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নেতৃত্বে বিশেষ টিম ওএমএসের আটা সরবরাহকারী মিলগুলো পরিদর্শন করেন। এ বছরের নভেম্বরের ২য় সপ্তাহে আটা সরবরাহকারীর তালিকা থেকে ২৯টি মিলের কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে অনিয়ম ও ত্রুটিপূর্ণ এবং সচল ও উৎপাদশীল না থাকায় ৪টি মিলের বরাদ্দ স্থগিত করে। স্থগিতকৃত রূপসার মেসার্স নিকলাপুর ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, খালিশপুর পুরাতন যশোর রোডের মেসার্স হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, ফুলবাড়ী গেটের মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিল ও খানজাহান আলী রোডের মেসার্স ডায়মন্ড ফ্লাওয়ার মিলের উপবরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়েছে।
এর আগে খুলনার কয়েকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওএমএস ডিলার অভিযোগ করে জানান, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাল আটা বিক্রির জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মিল মালিকদের গম বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সেখান থেকে ওএমএস ডিলারদের মিল মালিকরা আটা সরবরাহ করে। কিন্তু গত এক দেড় বছর ধরে কিছু মিলের অনিয়ম ও নিম্নমানের আটা সরবরাহ করে। এসব মিল বন্ধ থাকলেও সরকারের বরাদ্দ গম নিয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে নিম্নমানের আটা কিনে ডিলারদের সরবরাহ করে। ফলে সাধারণ মানুষ নিম্নমানের আটা কিনে অনেক ক্ষেত্রে খাওয়ার অনুপযোগী হওয়ায় সরকারের দুর্নাম সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে তারা সংশ্লিষ্ট খাদ্য বিভাগকে অবহিত করলেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ করেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তাজুল ইসলাম জানান, ওএমএসের আটা সরবরাহের জন্য তালিকাভুক্ত মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের পর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ তালিকাভুক্ত মিলগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি মিলে অনিয়ম ও ত্রুটিপূর্ণ এবং সচল ও উৎপাদনশীল না থাকায় বরাদ্দ স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিতকৃত মিলের উপবরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে সঠিকভাবে মিলগুলোকে বরাদ্দ প্রদানের জন্য খাদ্য পরিদর্শক পল্লব ঘোষের নেতৃত্বে একটি উপবরাদ্দ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে সচল ও উৎপাদনশীল মিলগুলোকে গম বরাদ্দ প্রদান করা হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিকে সফল করতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের জন্য খাদ্য বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাড. বাবুল হাওলাদার জানান, এটা খুবই দুঃখজনক যে, যেসব আটার মিল বন্ধ রয়েছে সেসব মিল মালিকেরা ওএমএস এর গম বরাদ্দ পাচ্ছে এবং বরাদ্দকৃত গমগুলো বাজারে বিক্রয় করে দিয়ে নিম্নমানের আটা ডিলারদের সরবরাহ করছে। আর সেই নিম্নমানের আটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে হতদরিদ্র অসহায়ম মানুষগুলো স্বল্পমূল্যে কিনছে। এখানে এসব অসহায় মানুষগুলোর প্রতি চরম অন্যায় করা হচ্ছে। সেই সাথে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হতদরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা প্রদানের সরকারের পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে।
এখানে বিষয়টি পরিষ্কার যে অসাধু মিল মালিক ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা এখানে জড়িত। এসব কর্মকর্তারা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য এসব অসাধু মিল মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে। আর এক্ষেত্রে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কোন ভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি।
খুলনার আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আব্দুস সালাম বলেন, আমি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে সাথে নিয়ে কয়েকটি মিল পরিদর্শন করেছি। এরমধ্যে ৪টি মিল সচল ও উৎপাদশীল না থাকায় মিলের বরাদ্দ স্থগিত করা জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত অন্য মিলগুলো আমি এখনো পরিদর্শন করতে পারিনি। অন্য মিলগুলোতে কোন অনিয়ম থাকলে সেগুলোর বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য