কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে বইছে হিম বাতাস। এতে বৃহস্পতিবার শীতে জবুথবু ছিল উত্তরাঞ্চলের মানুষ। ঠান্ডার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। নওগাঁয় কয়েক দিন ধরে বইছে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশা।
বদলগাছী আঞ্চলিক আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী কামাল উদ্দিন বলেন, বুধবার ভোর ৬ টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবারও তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। সন্ধ্যা নামার পর থেকে ঘন কুয়াশায় চারদিক ছেয়ে যায়। দুপুর ১২টার আগে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। দিনমজুরেরা শীতে মাঠে কাজ করতে পারছেন না। একদিকে গরম কাপড়ের অভাব, অন্যদিকে কাজে বের হতে না পারায় তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। তবে গরম কাপড়ের দোকানগুলোয় লোকজনের ভিড় বাড়ছে। ফুটপাতেও সোয়েটার বিক্রি হচ্ছে সমানতালে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় ও সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে ৪৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
রানীনগরের সিম্বা এলাকায় একটি গভীর নলকূপের শ্রমিক আবদুল জলিল জমিতে পানি সেচ দেয়ার সময় জমিতে পড়ে যান। লোকজন দেখতে পেয়ে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বুধবার জেলায় তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডার হাত থেকে বোরো বীজতলা রক্ষায় কৃষকদের লিফলেট বিলি করা হচ্ছে। বোরো বীজতলা রক্ষার জন্য সন্ধ্যায় বীজতলায় পানি সেচ দিতে হবে। ভোরে বীজতলা থেকে ওই পানি বের করে দিতে হবে। রাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ছাউনি দিতে হবে। সকালে ছাউনি তুলে নিতে হবে।
সদর উপজেলার পুরানাপৈল গ্রামের রিকশাচালক লুৎফর রহমান বলেন, পেটের দায়ে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি রিকশা নিয়ে শহরে আসেন। ঠান্ডায় রিকশা চালাতে কষ্ট হচ্ছে।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে গত তিন দিন থেকে ঘন কুয়াশা। শীতবস্ত্রের অভাবে শ্রমজীবী মানুষ বিপাকে পড়েছেন। তারা খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এরপরও অনেক কৃষিশ্রমিককে বুধবার মাঠে কাজ করতে দেখা গেছে। উপজেলার ঝাকুয়াটারী গ্রামের কৃষক আব্বাস মিয়া বলেন, ঠান্ডায় ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। কিন্তু বোরো চাষের সময় হয়ে আসছে। সে কারণে কাজ করতে হচ্ছে।
শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় শহরের লেপ-তোশকসহ গরম কাপড়ের দোকানে সাধারণ মানুষের ভিড় বেড়েছে। ভিড় বাড়ছে হাসপাতালেও। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বুকের দুধ পান করাতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং বাসি ও ঠান্ডা খাবার খাওয়া যাবে না।
পঞ্চগড়ে শৈত্যপ্রবাহে আলু, গমসহ রবিশস্য ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। ইতিমধ্যে বোরো ধানের বীজতলা হলুদ হতে শুরু করেছে। অনেকে বীজতলা পলিথিনে ঢেকে রেখেছে। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, তিন দিন ধরে পঞ্চগড়ে ৭ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠানামা করছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, জেলার শীতার্ত মানুষের কষ্ট কমাতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দর আবহাওয়া কার্যালয় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৭.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাড় কাঁপানো শীতের কারণে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। শহরের রাস্তাঘাট ছিল প্রায় ফাঁকা। বুধবার সারা দিনে সূর্যের দেখা মেলেনি।
সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের সিংদই গ্রামের দিনমজুর ইনছান আলী (৬০) বলেন, ‘তিন দিন থাকি কামত যাবার পাওছো না। হামার গরিব মাইনসের খুব কষ্ট হইছে। কেথা দিয়া জার পালায়ছে না। আইতত উঠি আগুন তাপির নাগেছে।’
পাবনার ঈশ্বরদীতে এ বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাঁড়া ইউনিয়নের মাঝদিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম বলেন, কাজের সন্ধানে তিনি দুই দিন ধরে রেলগেটে আসছেন। কিন্তু তীব্র শীতে তিনি কোনো কাজ পাচ্ছেন না। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুধবার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিল কম।
বেড়ায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। শীতে উপজেলার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়া মানুষের কষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এসব শীতার্ত মানুষের মধ্যে সরকারিভাবে কিছু শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে জানা গেছে। যমুনা নদীর তীরঘেঁষা বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে বাস করে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। ২০ বছর ধরে চলা যমুনা নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে তারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছে।
শুকচান বিবি বলেন, ‘গরম কাপড় নাই, তার ওপর ভাঙা বেড়া দিয়্যা ঘরে হর হর কইর্যা ঠান্ডা ঢোকে। শীতে এক্কেরে মইর্যা যাবার লাগচি। ঠান্ডার চোটে সারা রাইত জাইগ্যা থাকা লাগে।’
সিরাজগঞ্জে তিন দিন ধরে সূর্যের আলো দেখা যায়নি। যমুনা নদীর চরাঞ্চলসহ জেলার গ্রামগুলোর লোকজন ঠান্ডা বাতাসে জবুথবু হয়ে পড়েছে। শীতের কারণে সড়কে যানবাহন চলাচল কমে গেছে। জেলার ব্যস্ততম এলাকা হাটিকুমরুল গোল চত্বর বাসস্ট্যান্ডসহ শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, এম এ মতিন বাসস্ট্যান্ডে লোকজনের সমাগম নেই বললেই চলে। কুয়াশায় দিনের বেলায় হেড লাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। স্কুল-কলেজে উপস্থিতি কমে গেছে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য