-->

মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল, জমিদারবাড়ি সংরক্ষণের দাবি

বাকেরগঞ্জ (বরিশাল) প্রতিনিধি
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল, জমিদারবাড়ি সংরক্ষণের দাবি
শ্যামপুর গ্রামের কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবুর জমিদারবাড়ি

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামের কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবুর জমিদারবাড়ি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর এই বাড়িটি ও জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরুর পর বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছিল জমিদার বাড়িটি। এখানে বসেই মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা করা হতো।

 

১৬শ শতকের দিকে এ জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন প্রসন্ন কুমার রায় চৌধুরী। ১৯ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত জমিদারির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তাদের পঞ্চম বংশধর কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী (নাটু বাবু)।

 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর একজন জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি (নাটু বাবু) নিজ গ্রাম শ্যামপুরে সংগঠিত করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। জমিদার হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে সব প্রকার সহায়তা করেছেন জমিদারি কোষাগার থেকে। মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য অবদান রাখা নাটু বাবু বেশিদিন বাঁচতে পারেননি। স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১৯৭৩ সালে তাকে হত্যা করে স্থানীয় রাজাকার হাশেম আলী ও তার সহযোগীরা।

 

যুদ্ধকালীন ১৫ নভেম্বর স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িটিতে আক্রমণ চালায় পাকবাহিনী। সেইদিন সম্মুখযুদ্ধে তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ২১ পাক সেনা নিহত হয়। ওই যুদ্ধে ৩৫জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাক-বাহিনী।

 

নাটু বাবুর স্ত্রী ছায়া রায় চৌধুরী জানান, ১৯৭৩ সালে তার স্বামীকে হত্যার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটু বাবুর হত্যার বিচারে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পাশাপাশি তার সঙ্গে থাকা পাঁচ মাস বয়সের শিশু পুত্র বিপ্লবকে বঙ্গবন্ধু কোলে তুলে নিয়ে নাটু বাবুর চার সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জাতির পিতার এমন সহায়তার আশ্বাস পেলেও তা বেশি দিন টিকে থাকেনি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আবারও অন্ধকার নেমে আসে জমিদার পরিবারে।

 

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধীরা। এরপর থেকে নানাভাবে হয়রানি শুরু করে নাটু বাবুর পরিবারকে। যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। সেই পরিবারটি স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে আজও নিগৃহীত। জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ পরিবর্তন নিয়ে দেখা দেয় নানা রকম প্রতিবন্ধকতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টিতে ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়টির নাম ফলক উন্মোচন হয়।

 

বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার নব্বই বছর পরে শহিদ কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবু মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলেও আদৌ সংরক্ষিত হয়নি মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত তাদের এই জমিদারবাড়িটি। বরং কালের সাক্ষী হয়ে থাকা তাদের (জমিদার পরিবারের) বাড়িটি দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের সহযোগীরা।

 

অযত্নে-অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে জমিদারবাড়ি। ৬ দশমিক ৬৯ একর জমির ওপর গড়ে তোলা বাড়িটির মূল দোতলা ভবনটি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বাড়িতে ঢোকার মূল ফটকেরও একই অবস্থা। মূল দোতলা ভবনটিতে বাস করছেন কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর স্ত্রী ছায়া রায় চৌধুরী। বাড়ির ভেতরে বড় একটি দিঘি, একটি পুকুর ও বাগান আছে। এই পরিবারের জমির ওপর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্যামপুর বাজার, মসজিদ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বীর মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

 

বিজয়ের মাসে সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি সংরক্ষণ করার দাবি জানান, কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবুর পরিবারসহ বাকেরগঞ্জবাসী।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version