-->
শিরোনাম

পর্যটন খাতে রাজনৈতিক অস্থিরতার খড়গ

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার
পর্যটন খাতে রাজনৈতিক অস্থিরতার খড়গ
আশানুরূপ পর্যটক নেই কক্সবাজারে

নির্বাচন ঘিরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ধুঁকছে পর্যটন খাত। ডিসেম্বর মাস পর্যটনের সেরা সময়। ভ্রমণের উপযোগী আবহাওয়া ও স্কুল-কলেজ ছুটি থাকায় এসময় তিল ধারণের জায়গা থাকে না কক্সবাজার, বান্দরবান, সুন্দরবন, সিলেটসহ দেশের প্রধান পর্যটক এলাকায়। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো লোভনীয় অফার দিয়েও পর্যটক টানতে পারছে না। যানবাহনে আগুন-ভাঙচুর আতঙ্কে বাইরে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না কেউ।

 

পর্যটন সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অভিযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটন খাতে খরা চলছে। পর্যটন গন্তব্যে এয়ারলাইন্স ও বাস টিকিট বিক্রিতে নেমেছে ধস। বেশি ছাড়ের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও পর্যাপ্ত গ্রাহক নেই হোটেল-রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এভাবে চলতে থাকলে পর্যটন খাতে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের পথে বসতে হবে।

 

পর্যটনের ভরা মৌসুমে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পর্যটকরা। তাদের অভিযোগ, এখন বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে পরীক্ষা শেষ। বছর শেষে সবাই দেশের পর্যটন এলাকাগুলোতে যাওয়ার পরিকল্পনা নেন। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পরিবার নিয়ে তারা বের হতে ভয় পাচ্ছেন। তাই দাবি-দাওয়া আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিকল্প কিছু ভাবার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

 

গত ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপি-জামায়াত। এ নিয়ে ওইদিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এরপর থেকে টানা হরতাল-অবরোধ পালন করছে বিএনপি। তাদের কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়ে মাঠে রয়েছে জামায়াত। ফলে প্রতিটি কর্মসূচিতেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করছে দুর্বৃত্তরা।

 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্যমতে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৯৭টি বাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এই সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় গণপরিবহন এবং ট্রাক-কাভার্ডভ্যান কম চলায় পরিবহন খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।

 

জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সামদানী খন্দকার ভোরের আকাশকে বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের কারণে পর্যটন গন্তব্যে যেসব বাস যাত্রী পরিবহন করে, সেগুলোতে গড়ে ৭০ শতাংশ যাত্রী কমেছে। আর যাত্রী সংকটে বাসও চলছে কম। এতে পরিবহন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

 

সারা দেশে হরতাল অবরোধ পালন করেছে বিএনপি-জামায়াত। এ কর্মসূচির প্রথম প্রহরে তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে চারজন যাত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান। এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর অবরোধ চলাকালে গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেললাইন কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাশের খালে গিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় একজন যাত্রী নিহত হন।

 

হরতাল-অবরোধের কারণে গত নভেম্বর এবং চলতি মাসের প্রথম দিকে পর্যটন গন্তব্যগুলোতে যাত্রী তুলনামূলক কম ছিল বলে জানিয়েছে দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলো।

 

এ বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, নভেম্বরে হরতাল-অবরোধে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী গড়ে ১৫ শতাংশ কম ছিল। বিশেষ করে পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেটে যাত্রী অনেক কমছে। তবে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় আকাশপথে যাত্রীর চাহিদা আছে। পাশাপাশি বড়দিন ও নববর্ষ সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রুটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গন্তব্যেও যাত্রী চাহিদা বাড়ছে।

 

রাজধানীর শান্তিনগরের বাসিন্দা ফারুক আলম। পেশায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। আগামী ২৯ ডিসেম্বর রাতে তিন দিনের সফরে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। কিন্তু হরতাল-অবরোধে সড়কপথে পরিবার নিয়ে ভ্রমণে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। আবার আকাশপথে উড়োজাহাজে কক্সবাজারে যাওয়ার সামর্থ্যও নেই তার। তারপরও মঙ্গলবার ফকিরাপুলে একটি ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে উড়োজাহাজে ঢাকা-কক্সবাজার-ঢাকা টিকিটের খরচ জানতে যান।

 

এসময় কথা হয় ফারুক আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরের ডিসেম্বরে পরিবার নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাই। কিন্তু এবার হরতাল-অবরোধে পরিবার নিয়ে সড়কপথে যেতে ভয় হচ্ছে। তাই উড়োজাহাজে ভাড়া কেমন পড়বে খোঁজ নিচ্ছি। কিন্তু সড়কপথের চেয়ে উড়োজাহাজে খরচ প্রায় তিনগুণ বেশি। আবার কম খরচে নতুন চালু হওয়া কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনে কক্সবাজার যাওয়া-আসার টিকিট পাচ্ছি না।’

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট ২০২০-এর তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল তিন শতাংশ। এছাড়া সে বছর এ খাতে মোট কর্মসংস্থান ছিল চার শতাংশ।

 

দেশে পর্যটন মৌসুম সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মাঝা-মাঝি পর্যন্ত চলে। শীতের মাসগুলোয় থাকে ভরা মৌসুম। প্রায় ৫০০ হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট ছাড়াও দুই হাজারেরও বেশি খাবারের দোকান নিয়ে কক্সবাজার দেশের শীর্ষ পর্যটন স্থান। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ খাতে খরা চলছে বলে জানিয়েছেন ওশান প্যারাডাইসের জনসংযোগ কর্মকর্তা সায়ীদ আলমগীর।

 

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘এই সময়ে কক্সবাজার পর্যটকে টইটম্বুর থাকার কথা। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যটনে খরা চলছে। ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে পর্যটক কিছুটা বাড়ছে। আমরা ধারণা করছি ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কিছু পর্যটক পাবো।’

 

তিনি বলেন, ‘আগে পর্যটন মৌসুমে গণমাধ্যমে খবর হতো, হোটেলে কক্ষ না পেয়ে রাস্তায় রাত কাটালেন পর্যটকরা। এছাড়া অতীতে এমন সময় গেছে দিনের ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সড়কে যানজট তৈরি হতো। রাতেও বিচে লোকজন যেত। এবছর তার উল্টোটা হয়েছে। এখন কক্সবাজারের সড়ক ফাঁকা।’

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version