নাটোরের সিংড়া উপজেলার ১৫৪ কিলোমিটার খাল কেনাবেচা করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। চলনবিলের ১৫৪ কিলোমিটার খালের অধিকাংশ স্থান বেদখল হয়ে আছে। সরকারি অর্থায়নে কাটা এসব খাল কেনাবেচা করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। মাছ ধরার জন্য খাল সেচে ফেলার কারণে সেচ সুবিধা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন কৃষকেরা। বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পক্ষ থেকে খাল রক্ষার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হলেও আশানুরূপ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও খাল রক্ষার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (ক্ষুদ্র সেচ) সিংড়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গত তিন অর্থবছরে সরকারি অর্থায়নে চলনবিলের নাটোরের সিংড়া উপজেলা অংশে ১৫৪ কিলোমিটার খাল খনন ও পুনঃখনন করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এসব খাল চলনবিলের পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। বর্ষা শেষে বিলের পানি এসব খাল দিয়ে নদীতে নেমে যায়। বিলের সব দেশি প্রজাতির মাছ আশ্রয় নেয় এসব খালে। খাল না শুকিয়ে এসব মাছ ধরার অধিকার রয়েছে সাধারণ মানুষের। খালের পানি সেচে বোরো ধানসহ চৈতালি ফসল ফলানোর সুযোগও রয়েছে। ভূ-উপরিস্থ এই পানি ব্যবহার করায় ভূগর্ভস্থ পানির চাপ হ্রাস পায়। এতে মাটির মান স্বাভাবিক থাকে।
এ সম্পর্কে বিএডিসি সিংড়া জোনের সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) মানিক রতন বলেন, তারা গত তিন অর্থবছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫৪ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করেছেন। এতে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারের মাধ্যমে সেচসুবিধা সম্প্রসারিত হয়েছে। কৃষকেরা স্বল্প খরচে সেচসুবিধা পাচ্ছেন।
কিন্তু প্রকল্পের এসব উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের খাল দখলের মধ্য দিয়ে। প্রভাবশালীরা এসব খাল দখল করে বাঁধ দিয়ে দিচ্ছেন। খালের পানি সেচে মাছসহ জলজ প্রাণী নিধন করছেন তারা। কৃষকেরা সেচসুবিধা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন। জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন এসব খাল থেকে মাছ ধরতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে অর্থের বিনিময়ে খাল কিনে নিয়ে মাছ ধরছেন তাঁরা।
পরিস্থিতি জানিয়ে ১৪ ডিসেম্বর বিএডিসির সিংড়া জোনের সহকারী প্রকৌশলীর (ক্ষুদ্র সেচ) কার্যালয় থেকে সিংড়া ইউএনও, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও মৎস্য কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
১৫ ডিসেম্বর এই প্রতিনিধি সিংড়ার ইটালী ইউনিয়নের তিশিখালী খাল ঘুরে দেখেন। বিএডিসি গত দুই অর্থবছরে খালটির ৫ দশমিক ৯০ কিলোমিটার অংশ পুনঃখনন করেছে। ১ কোটি ৩৫ লাখ ১২ হাজার ৭ টাকা খরচে পুনঃখনন করা এই খাল সংস্থার বেহাত হয়ে গেছে। পুনঃখননের ফলে হিজলী, সাতপুকুরিয়া, নদীমারী, বোয়ালমারী, পুকুরপাড়, ষষ্ঠীবিঘা, নুরপুর, কাদোগাড়ী, ডাহিয়া, মহেশচন্দ্রপুর এবং কালীনগর বিলের পানির যে সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরিকল্পনা অনুসারে এই খালের পানি দিয়ে আড়াই হাজার হেক্টর জমি বোরো মৌসুমের শুরুতে চাষাবাদ শুরু করার কথা ছিল। তবে তা সম্ভব হয়নি।
এই খালের হিজলী শ্মশান থেকে তিশিখালী মাজার হয়ে কালীনগর এলাকা পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার অংশ ডাল-বাঁশ ফেলে দখল করে নেওয়া হয়েছে। খালে পাহারা বসিয়েছেন ডাহিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী।
তিনি জানান, খালের এই অংশ তিনি ৬ লাখ টাকায় ইটালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কাজল খাঁর কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। এখন খালটি শুকিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খালের অপর এক কিলোমিটার অংশে দুটি শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডাহিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী কামাল হোসেন, হিরা আলী ও রুবেল সরদার। এই অংশ তাঁরা সাতপুকুরিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন।
এ ছাড়া তিশিখালী ডুবাব্রিজ থেকে ডাহিয়া রাস্তার ডুবাব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার খাল ও পদ্দগাড়ী ভেলুয়ার বিল দখল করে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী মজিবর সরকার ও তাঁর লোকজন। এই খালে বানার বাঁধ দেওয়ার কাজে নিয়োজিত মেহের আলী ও খুরশেদ আলী বলেন, তাঁরা এই অংশ একটি মৎস্যজীবী সমিতির নামে ভোগদখল করেন। এখানে কাউকে কোনো টাকা দিতে হয়নি।
স্থানীয় কৃষক মজিবর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, ‘শুনেছি, খালটি কাটা হয়েছে কৃষক ও জেলেদের জন্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা এই খালের সুবিধা ভোগ করতে পারি না। আমরা নেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছি।’
চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পানির স্বাভাবিক গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছেন কতিপয় ব্যক্তি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি। প্রশাসন মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহাদৎ হোসেন বলেন, ‘খালের পানি সেচে মাছ ধরা বেআইনি। এতে দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। খবর পেলে আমরা অবৈধ মাছশিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
সিংড়ার ইউএনও মাহমুদা খাতুন জানান, খাল দখলের অভিযোগ পেয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে খাল দখলকারীদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে আরও বেশি অভিযান চালানো হবে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য