-->
শিরোনাম

জলের জমিনে সবজির প্রাচুর্য

রাশেদ জুয়েল, কিশোরগঞ্জ
জলের জমিনে সবজির প্রাচুর্য
ক্যাপশন : হাওড়ের উঁচু জমিতে ঘটেছে নীরব বিপ্লব

বর্ষা মৌসুমে যেখানে থইথই পানির তরঙ্গসঙ্কুল উত্তাল জলরাশি সেখানে এখন সবুজের ঢেউ। কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এখন ফসলের মাঠ। অপেক্ষাকৃত নিচু জমিগুলো বোরো ধানের জন্য প্রস্তুত করা হলেও উঁচু জমিগুলো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে সবজি ও রবিশস্যের আবাদে।

 

জেলার বেশিরভাগ হাওরই এখন বেগুন, আলু, টমেটো, খিরা, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, ডাঁটাশাক, মাষকলাই, মরিচ ও লাউয়ের ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। অথচ এক দশক আগেও এ দৃশ্য অকল্পনীয় ছিল হাওরবাসীর কাছে।

 

বছরের বেশিরভাগ সময় পানির নিচে থাকা এসব জমিতে এত দিন বোরো আবাদই ছিল একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু বন্যা ও বাঁধ ভাঙনে প্রায়ই সলিলসমাধি হতো এই সোনার ধানের। এর মধ্যে আবার ধানের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে নিত্য সংগ্রাম তো ছিলই। এসব কারণই সবজি চাষে আগ্রহী করে কৃষকদের।

 

সরেজমিনে জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার হাওরসমৃদ্ধ গনেশপুর, মুড়িকান্দি, ছাগুলি, উত্তর গনেশপুর, নিয়ামতপুর, ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা, বরিবাড়ি, মিঠামইন উপজেলার কামালপুর, ইসলামপুর, মহিষারকান্দি, বোরনপুর অষ্টগ্রাম উপজেলার খয়েরপুর, মধ্য অষ্টগ্রাম, আবদুল্লাহপুর, বাঙালপাড়া নিকলী উপজেলার নানশ্রী, কারপাশা, ছাতিরচর, দামপাড়া, সিংপুরসহ ২৫ গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার তুলনামূলক উঁচু জমিগুলোতে শাকসবজি ও রবিশস্যের ব্যাপক চাষাবাদ হয়েছে। নতুন এই চাষাবাদে সুফলও মিলছে হাতেনাতে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে চাষাবাদের পরিমাণও।

 

ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা গ্রামের সবজি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ফরিদ মিয়া ছিলেন বর্গাচাষি। কয়েক বছর ধরে শাক-সবজি করে সুফল পেয়েছেন। একসময় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতেন। একই গ্রামের একাধিক কৃষক জানান, কয়েক বছর ধরে তারা হাওরে সবজি ও রবিশস্য উৎপাদন করে তাদের জীবনের মোড় ঘোরাতে সক্ষম হয়েছেন।

 

সবজিচাষিরা জানান, একফসলি জমিতে বোরো ধান আবাদ ও মাড়াইয়ের পরপরই বর্ষা মৌসুম শুরু হয়। এ সময় হাওরে বসবাসরত একটি বিরাট জনগোষ্ঠী ভাসান পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকে। প্রায় ছয় মাস তাদের বেকার থাকতে হতো। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে হাওর থেকে পানি নেমে যায়। উজান এলাকায় এ সময় সবজি চাষ ও উৎপাদন দেখে হাওরের কোনো কোনো এলাকার চাষিরা পানি নামার পরপরই হাওরে সবজি চাষের উদ্যোগ নেন।

 

প্রায় দেড় দশক আগে পরীক্ষামূলকভাবে হাওরের চাষিরা সবজি চাষ শুরু করলেও ফলাফল তেমন ভালো আসেনি। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের পরামর্শক্রমে চাষিরা ‘গ্রামভিত্তিক সবজি উৎপাদন কমিটি’ গড়ে তুলে সবাইকে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবেই হাওরে শুরু হয় সবজি বিপ্লব।

 

ইটনা উপজেলার শিমুলবাঁক গ্রামের সবজিচাষি সমিতির সভাপতি মো. কফিল উদ্দিন ভূইয়া ভোরের আকাশকে জানান, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবজি চাষে গ্রামের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে। গভীর হাওরে প্রথম সবজি পথ দেখিয়েছে তারা। তারা কৃষকদের স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে।

 

মিঠামইন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আছিয়া আলম জানান, হাওরে সবজি চাষ তাদের বাপ-দাদারা দেখে যেতে পারেননি। দুই যুগ আগেও সবজি চাষ ছিল না। হাওরের কৃষকরা উৎসাহী হয়ে শুরু করে অনেকটাই নিরাশার মধ্যে ছিল। গত কয়েক বছর ধরে সবজি চাষে বিপ্লব হয়ে গেছে। এক গ্রামকে অনুসরণ করে অন্য গ্রামে সবজি চাষ হচ্ছে। দিনে দিনে সবজি চাষ ও রবিশস্য চাষের পরিধি বাড়ছে।

 

মিঠামইন উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরীফ কামাল জানান, কিশোরগঞ্জের আটটি হাওর ও আংশিক হাওর উপজেলার প্রায় ২৫০টি গ্রামে সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ২০ হাজার দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের আড়াই লক্ষাধিক মানুষ এতে উপকৃত হচ্ছে।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবদুস সাত্তার বলেন, এ বছরের চাষাবাদ এবং প্রাথমিক উৎপাদন দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি। কৃষকেরাই আমাদের বাজারব্যবস্থার সার্বিক চিত্র বদলে দিতে পারে। হাওরে সবজি চাষ তার প্রমাণ। হাওরে কর্মরত উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকতার্দের সবজি চাষে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version